রোহিঙ্গা সংকট ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি: কেবল মানবিক নয়, নিরাপত্তাজনিতও
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে যে জটিল মানবিক সংকট বিরাজ করছে, তা হলো রোহিঙ্গা ইস্যু। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রায় ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বর্তমানে কক্সবাজারের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এবং কিছু সংখ্যক ভাসানচরে প্রায় ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। আন্তর্জাতিক মহলে এ সংকটকে একটি মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা হলেও, বাস্তবে এটি শুধু মানবিক নয়—বরং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থানের জন্যও একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি।
রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে সীমান্তবর্তী এলাকায় সামরিক নজরদারি বাড়ানো হলেও এখনও অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। কক্সবাজার অঞ্চলে যে মাত্রার জনঘনত্ব তৈরি হয়েছে, তা রীতিমতো একটি নিরাপত্তাহীন ‘গৃহহীন শহর’ গড়ে তুলেছে। এখানে প্রায় প্রতিদিন মাদক পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, মানবপাচার এবং চোরাচালানের মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যা শুধু সীমান্ত নয় বরং দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং সামরিক বিশ্লেষকরা বারবার সতর্ক করে আসছেন যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ধীরে ধীরে অপরাধচক্র, মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের জন্য এক ধরনের আশ্রয়স্থলে পরিণত হচ্ছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশ সরকার এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ সংকটকে ‘নিরাপত্তাজনিত বিপর্যয়’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিওগুলোর দ্বারা পরিচালিত মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের আড়ালে নিরাপত্তার যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা এখন রাষ্ট্রের জন্য বড় রকমের কৌশলগত দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ সংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে ভবিষ্যতে এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করতে পারে। কারণ, এই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রহীন রেখে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করে রাখার ফলে সেখানে একটি ‘ডি-ফ্যাক্টো’ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, যার মধ্যে গড়ে উঠছে নিজস্ব প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এতে শুধু জাতিসংঘ নয়, বিভিন্ন বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাও নজর রাখছে। এ বাস্তবতা বাংলাদেশকে একটি ‘স্মল পাওয়ার’-এর জায়গা থেকে সরিয়ে ‘জিও-পলিটিক্যাল কনটেইনমেন্ট’ বা বড় শক্তির মোহজালে আটকে ফেলতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতিকে কেবল সীমান্ত পাহারা নয়, বরং ‘আন্তঃখাতীয় নিরাপত্তা নীতি’ হিসেবে পরিগণিত করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটের ফলে ভবিষ্যতে যদি এই অঞ্চল থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর পাল্টা হামলার কোনো উদ্যোগ গড়ে ওঠে, কিংবা যদি কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী সেখানে সক্রিয় হয়, তাহলে বাংলাদেশকেই আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হবে।
অন্যদিকে, কক্সবাজারের জিওগ্রাফিক অবস্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চল বঙ্গোপসাগরের খুব কাছে এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ এবং মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। ফলে কক্সবাজারকে নিরাপত্তাহীন রাখতে পারলে, অনেক বড় কৌশলগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যায়—এমনটা অনেক কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকের মত।
আমরা যদি এখনই সামরিক ও কৌশলগত পরিকল্পনায় রোহিঙ্গা সংকটকে অন্তর্ভুক্ত না করি, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এমন এক সংকটের মুখোমুখি হতে পারে, যেখানে প্রতিক্রিয়া জানানোর মতো সময়ও থাকবে না। এই মুহূর্তে প্রয়োজন, একটি উচ্চপর্যায়ের 'ন্যাশনাল সিকিউরিটি টাস্কফোর্স' গঠন করা—যেখানে সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা একত্রে এই ইস্যুতে সমন্বিত নীতি গ্রহণ করবেন।
একটি দেশের প্রতিরক্ষা শুধু শত্রুপক্ষকে ঠেকানো নয়, বরং সম্ভাব্য হুমকিকে আগেই চিহ্নিত করে কৌশল গ্রহণ করাই হলো প্রকৃত অর্থে ‘নিরাপত্তা’। রোহিঙ্গা সংকট এখন একটি মানবিক সমস্যা হলেও, তা কৌশলগত অবহেলার কারণে ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পরিণত হতে পারে। তাই এই সংকটকে অবজ্ঞা করা নয়, বরং তা মোকাবিলার জন্য শক্তিশালী, সমন্বিত এবং দূরদর্শী প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি গ্রহণ করাই হবে বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত কৌশল।