রোহিঙ্গা সংকট ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি: কেবল মানবিক নয়, নিরাপত্তাজনিতও !

রোহিঙ্গা সংকট ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি: কেবল মানবিক নয়, নিরাপত্তাজনিতও !

Image: The Associated Press

By Admin User

Reporting from Dhaka - June 26, 2025

রোহিঙ্গা সংকট ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি: কেবল মানবিক নয়, নিরাপত্তাজনিতও


বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে যে জটিল মানবিক সংকট বিরাজ করছে, তা হলো রোহিঙ্গা ইস্যু। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রায় ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বর্তমানে কক্সবাজারের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এবং কিছু সংখ্যক ভাসানচরে প্রায় ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। আন্তর্জাতিক মহলে এ সংকটকে একটি মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা হলেও, বাস্তবে এটি শুধু মানবিক নয়—বরং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থানের জন্যও একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি।

রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে সীমান্তবর্তী এলাকায় সামরিক নজরদারি বাড়ানো হলেও এখনও অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। কক্সবাজার অঞ্চলে যে মাত্রার জনঘনত্ব তৈরি হয়েছে, তা রীতিমতো একটি নিরাপত্তাহীন ‘গৃহহীন শহর’ গড়ে তুলেছে। এখানে প্রায় প্রতিদিন মাদক পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, মানবপাচার এবং চোরাচালানের মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যা শুধু সীমান্ত নয় বরং দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং সামরিক বিশ্লেষকরা বারবার সতর্ক করে আসছেন যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ধীরে ধীরে অপরাধচক্র, মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের জন্য এক ধরনের আশ্রয়স্থলে পরিণত হচ্ছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশ সরকার এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ সংকটকে ‘নিরাপত্তাজনিত বিপর্যয়’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিওগুলোর দ্বারা পরিচালিত মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের আড়ালে নিরাপত্তার যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা এখন রাষ্ট্রের জন্য বড় রকমের কৌশলগত দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ সংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে ভবিষ্যতে এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করতে পারে। কারণ, এই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রহীন রেখে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করে রাখার ফলে সেখানে একটি ‘ডি-ফ্যাক্টো’ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, যার মধ্যে গড়ে উঠছে নিজস্ব প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এতে শুধু জাতিসংঘ নয়, বিভিন্ন বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাও নজর রাখছে। এ বাস্তবতা বাংলাদেশকে একটি ‘স্মল পাওয়ার’-এর জায়গা থেকে সরিয়ে ‘জিও-পলিটিক্যাল কনটেইনমেন্ট’ বা বড় শক্তির মোহজালে আটকে ফেলতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতিকে কেবল সীমান্ত পাহারা নয়, বরং ‘আন্তঃখাতীয় নিরাপত্তা নীতি’ হিসেবে পরিগণিত করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটের ফলে ভবিষ্যতে যদি এই অঞ্চল থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর পাল্টা হামলার কোনো উদ্যোগ গড়ে ওঠে, কিংবা যদি কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী সেখানে সক্রিয় হয়, তাহলে বাংলাদেশকেই আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হবে।

অন্যদিকে, কক্সবাজারের জিওগ্রাফিক অবস্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চল বঙ্গোপসাগরের খুব কাছে এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ এবং মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। ফলে কক্সবাজারকে নিরাপত্তাহীন রাখতে পারলে, অনেক বড় কৌশলগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যায়—এমনটা অনেক কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকের মত।

আমরা যদি এখনই সামরিক ও কৌশলগত পরিকল্পনায় রোহিঙ্গা সংকটকে অন্তর্ভুক্ত না করি, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এমন এক সংকটের মুখোমুখি হতে পারে, যেখানে প্রতিক্রিয়া জানানোর মতো সময়ও থাকবে না। এই মুহূর্তে প্রয়োজন, একটি উচ্চপর্যায়ের 'ন্যাশনাল সিকিউরিটি টাস্কফোর্স' গঠন করা—যেখানে সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা একত্রে এই ইস্যুতে সমন্বিত নীতি গ্রহণ করবেন।

একটি দেশের প্রতিরক্ষা শুধু শত্রুপক্ষকে ঠেকানো নয়, বরং সম্ভাব্য হুমকিকে আগেই চিহ্নিত করে কৌশল গ্রহণ করাই হলো প্রকৃত অর্থে ‘নিরাপত্তা’। রোহিঙ্গা সংকট এখন একটি মানবিক সমস্যা হলেও, তা কৌশলগত অবহেলার কারণে ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পরিণত হতে পারে। তাই এই সংকটকে অবজ্ঞা করা নয়, বরং তা মোকাবিলার জন্য শক্তিশালী, সমন্বিত এবং দূরদর্শী প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি গ্রহণ করাই হবে বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত কৌশল।

Related Topics:

Share:

"ইরান ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: প্রযুক্তি, কৌশল ও বাস্তবতা"

"ইরান ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: প্রযুক্তি, কৌশল ও বাস্তবতা"

Image: The Associated Press

By Admin User

Reporting from Dhaka - June 25, 2025

ইরান ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি বাস্তবসম্মত আলোচনা


ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা শুধু ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে নয়, তাদের উন্নত সামরিক সক্ষমতার জন্যও বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব পাচ্ছে। উভয় দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে তাদের সুরক্ষা দেয়, আক্রমণ প্রতিহত করে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করে তা বোঝা জরুরি। এই প্রবন্ধে পক্ষপাতহীন ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।


ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

ইরানের প্রতিরক্ষা নীতি তার ভৌগলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং প্রযুক্তিগত প্রবেশাধিকারের ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা আত্মনির্ভরশীলতার দিকে ঝুঁকেছে।

  • ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা: ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রোগ্রাম মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে অন্যতম উন্নত। ক্ষেপণাস্ত্রের দূরত্ব ও ক্ষমতা ভিন্নতর, যা আঞ্চলিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।

  • বায়ু প্রতিরক্ষা: ইরানের বায়ু প্রতিরক্ষা বহুস্তরীয়। তারা সোভিয়েত যুগের S-200 এবং নিজস্ব ‘বাবর-৩৭৩’ সিস্টেম ব্যবহার করে। তবে অনেক সিস্টেমের ইলেকট্রনিক্স পুরনো এবং রক্ষণাবেক্ষণ দুর্বল, যা উন্নত হুমকির বিরুদ্ধে সীমিত কার্যকারিতা প্রদান করে।

  • নৌ প্রতিরক্ষা: ইরানের নৌবাহিনী ছোট দ্রুতগতির যুদ্ধজাহাজ, মাইন ও উপকূলীয় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে হরমুজ প্রণালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ জলে অস্বাভাবিক যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগ করে।

  • সাইবার ও ড্রোন যুদ্ধ: ইরান সাইবার সুরক্ষা ও ইউএভি (ড্রোন) সক্ষমতা বাড়িয়েছে, যদিও ইসরায়েলের তুলনায় প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে।

  • সীমাবদ্ধতা: অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রযুক্তি ও আপগ্রেডে সমস্যা আছে, বিশেষ করে উন্নত ইলেকট্রনিক্স ও সুনির্দিষ্ট অস্ত্র তৈরিতে।


ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

ইসরায়েল বিশ্বের অন্যতম আধুনিক ও সংহত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এটি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ও নিজের প্রতিরক্ষা শিল্পের কারণে সম্ভব হয়েছে।

  • ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা: ইসরায়েলের বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আছে ‘আইরন ডোম’ (স্বল্প দূরত্ব), ‘ডেভিড’স স্লিং’ (মধ্য দূরত্ব) ও ‘অ্যারো’ (দীর্ঘ দূরত্ব)। ‘আইরন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে সফলতার হার অনেক বেশি।

  • বায়ু প্রতিরক্ষা ও বিমান বাহিনী: আধুনিক যুদ্ধবিমান যেমন F-35 ব্যবহার করে, উন্নত রাডার ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ প্রযুক্তি রয়েছে।

  • সাইবার প্রতিরক্ষা: ইসরায়েল সাইবার যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষায় বিশ্বনেতা। সাইবার গোয়েন্দা ও আক্রমণ দুটোতেই তারা দক্ষ।

  • ড্রোন প্রযুক্তি: অত্যাধুনিক ড্রোন ব্যবহারে ইসরায়েল এগিয়ে, যা গোয়েন্দা ও সুনির্দিষ্ট হামলায় কাজে লাগে।

  • চ্যালেঞ্জ: ক্রমবর্ধমান উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হুমকি মোকাবিলায় প্রযুক্তি উন্নয়ন ও ব্যয় বৃদ্ধি প্রয়োজন। হামলার পরিমাণ বেশি হলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চাপ পড়তে পারে।

তুলনামূলক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট

  • প্রযুক্তিগত পার্থক্য: প্রযুক্তিগত দিক থেকে ইসরায়েল অনেক এগিয়ে, যা নিয়মিত উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় সম্ভব হয়েছে। ইরান নির্ভরশীলতা কমাতে নিজস্ব উন্নয়ন করছে, কিন্তু এখনও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে।

  • কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি: ইরান বেশি নির্ভর করে অ্যাসিমেট্রিক কৌশল ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে, যেখানে ইসরায়েল বহুতল প্রতিরক্ষা ও প্রি-এম্পটিভ স্ট্রাইক কৌশল অনুসরণ করে।

  • আঞ্চলিক নিরাপত্তা: দুই দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা অবস্থাকে প্রভাবিত করে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সতর্কতা ও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতা অঞ্চলীয় ভারসাম্যের অংশ।

  • নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ: উভয় দেশের সিস্টেম নিখুঁত নয়। ইরানের অনেক সিস্টেম পুরনো, ইসরায়েলের সিস্টেম উন্নত হলেও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত আপগ্রেড প্রয়োজন।


উপসংহার

ইরান ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের নিজ নিজ কৌশল, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা চাহিদার ফল। ইসরায়েল প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকলেও ইরানও নিজস্ব কৌশল ও অস্ত্র তৈরিতে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। পক্ষপাতহীনভাবে এই তথ্যগুলো বোঝা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য জরুরি।

Related Topics:

Share: