বিশ্ব রাজনীতির অস্থিরতায় বাংলাদেশ: নীরবতা না কৌশলগত প্রস্তুতি?
বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি এক ভয়াবহ ও অস্থির সময় অতিক্রম করছে। ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান সংঘাত এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের একটি আঞ্চলিক সংকট নয়—এই উত্তেজনার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এমনকি বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত। এই সংঘাত আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং কৌশলগত ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা কি যথেষ্ট প্রস্তুত? আমাদের জাতীয় কৌশল কি এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় টিকে থাকার মতো শক্তিশালী?
যুদ্ধ, জ্বালানি ও বাংলাদেশের ঝুঁকি
বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ জ্বালানি পণ্য পরিবাহিত হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যদি এই অঞ্চলকে অচল করে তোলে, তাহলে বিশ্বজুড়ে তেলের দাম বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প খাতের অনেকটাই জ্বালানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে গেলে তা সরাসরি আমাদের অর্থনীতিকে আঘাত করবে। বিদ্যুৎ, পরিবহন ও শিল্প খরচ বেড়ে যাবে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমবে। অর্থনীতিতে দেখা দেবে মুদ্রাস্ফীতি ও স্থবিরতা।
তাহলে প্রশ্ন হলো, আমরা কি প্রস্তুত?
রাষ্ট্র কি সজাগ, নাকি নিঃশব্দ?
দুঃখজনকভাবে, আন্তর্জাতিক অস্থিরতার এমন সংকটময় সময়েও বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান প্রায় নীরব। নেই কোনো সর্বদলীয় আলোচনার উদ্যোগ, নেই কোনো জাতীয় প্রচারণা বা জনসচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা। সরকারের পক্ষ থেকেও বড় কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা দৃশ্যমান নয়।
এ ধরনের নিস্ক্রিয়তা বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি দুর্বল সংকেত পাঠায়। চুপ থাকা এখন আর নিরপেক্ষ থাকা নয়, বরং কৌশলগত দুর্বলতার পরিচয়।
কৌশল নয়, কেবল উন্নয়ন কি যথেষ্ট?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হ্যান্স জে মরগেনথাউ তাঁর বই Politics Among Nations-এ বলেছেন, একটি রাষ্ট্রের শক্তি কেবল অর্থনীতি বা সামরিক ক্ষমতার ওপর নয়, বরং জনসংখ্যা, রাজনৈতিক ঐক্য, নেতৃত্বের দৃঢ়তা, প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৌশলগত দূরদর্শিতার ওপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটাই প্রযোজ্য। আমাদের উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন যতই হোক, রাজনৈতিক বিভাজন, নেতৃত্বের দুর্বলতা ও কৌশলগত প্রস্তুতির অভাব আমাদের সার্বিক শক্তিকে দুর্বল করে রেখেছে।
ইরানের উদাহরণ: যুদ্ধ কেবল অস্ত্র দিয়ে হয় না
ইরান বর্তমানে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করছে—একটি বাহ্যিক, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে; আরেকটি অভ্যন্তরীণ, যেখানে নানা ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী ও বিদেশি প্রভাব সক্রিয়। তবুও ইরান টিকে আছে, কারণ তাদের কৌশলগত কাঠামো শক্তিশালী।
তাদের বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাভিত্তিক, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রযুক্তিনির্ভর, কূটনৈতিক নেটওয়ার্ক সক্রিয়। আবেগ নয়—তারা যুদ্ধ করছে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কৌশলের ভিত্তিতে।
বাংলাদেশ কি এরকম কোনো কৌশলগত কাঠামো গড়ে তুলেছে? আমাদের কি কোনো ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডকট্রিন আছে? বিশ্ববিদ্যালয়, সেনাবাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কি সমন্বিত বিশ্লেষণ কাঠামো গড়ে উঠেছে?
উত্তর যদি “না” হয়, তবে আমরা সামনে ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়তে পারি।
ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় কৌশল জরুরি
বাংলাদেশ এখন একটি 'স্ট্র্যাটেজিক প্রেসার জোন'-এর মধ্যে রয়েছে—চারপাশে ভারতের প্রভাব, মিয়ানমারের সংকট, রোহিঙ্গা সমস্যা, বঙ্গোপসাগরের সম্পদ নিয়ে আন্তর্জাতিক আগ্রহ, চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের করিডর প্রতিযোগিতা।
এই বাস্তবতায় কেবল আমলাতান্ত্রিক নীতিতে পররাষ্ট্রনীতি চালানো যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সামরিক, বেসামরিক, একাডেমিক এবং কূটনৈতিক স্তরে সমন্বিত পরিকল্পনা।
‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি ও তরুণ প্রজন্ম
আজকের বাস্তবতায় আমাদের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হওয়া উচিত মানসিকতা, প্রযুক্তি ও কৌশলগত সচেতনতায়।
আমাদের তরুণরা যদি কেবল বিনোদননির্ভর হয়ে পড়ে, আর কৌশল, বিজ্ঞান ও নিরাপত্তা বিষয়ে অজ্ঞ থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র দুর্বল হবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমের অংশ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও প্রয়োজন ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি, যা কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং নাগরিক দায়িত্ববোধের মেরুদণ্ড হবে।
জাতীয় নিরাপত্তা রূপরেখা তৈরি করুন
এই মুহূর্তে দেশের প্রজ্ঞাবান নাগরিক, কূটনীতিক, গবেষক, রাজনীতিবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের নিয়ে একটি জাতীয় সংলাপ ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তোলার সময় এসেছে।
এটি কেবল সরকারের নয়, বরং জাতির নীতি হবে—যেখানে সংকট মোকাবিলায় থাকবে প্রস্তুতি, নেতৃত্ব ও ঐক্য।
শেষ কথা
একটি ছোট রাষ্ট্র তখনই টিকে থাকে, যখন তার আছে দূরদর্শিতা, ঐক্য ও কৌশল।
বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান আমাদের এই সক্ষমতা দিয়েছে। এখন প্রয়োজন শুধু সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।