২০২৫–২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট: আধুনিকায়ন, কৌশল ও নিরাপত্তা প্রস্তুতির দিকচিত্র
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে ৪০ হাজার ৮৫১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে। এটি দেশের সামরিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে নির্দেশ করছে—যখন বাংলাদেশ একদিকে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক বাহিনী গড়ার চেষ্টায় আছে, অন্যদিকে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
এই বাজেট শুধুই সংখ্যার হিসাব নয়; এটি দেশের সামরিক ও কৌশলগত দিকনির্দেশনার প্রতিফলন, যা ‘Forces Goal 2030’-এর পথরেখাকে বাস্তবায়নে গতি দিচ্ছে।
🔹 প্রতিরক্ষা বরাদ্দের বিবরণ: কে কত পাচ্ছে?
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় একটি অংশ যাবে প্রতিটি বাহিনীর দৈনন্দিন কার্যক্রম, অবকাঠামো উন্নয়ন, সরঞ্জাম সংগ্রহ এবং প্রশিক্ষণের খাতে। যদিও এই বাজেটের পুরো বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি, তবে সূত্রগুলো জানায়:
-
সেনাবাহিনী পাবে বাজেটের বড় অংশ, কারণ তারা দেশের স্থলভিত্তিক নিরাপত্তার মূল ভরসা। আধুনিক যানবাহন, অস্ত্র ও নজরদারি ড্রোন সংযোজনের পরিকল্পনা রয়েছে।
-
নৌবাহিনীর জন্য বাজেটে সাবমেরিন ও সমুদ্র-সীমান্ত নজরদারি সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব আছে। চট্টগ্রাম ও পায়রা নেভাল বেস সম্প্রসারণ এই বাজেটের অন্তর্ভুক্ত।
-
বিমান বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বরাদ্দ রয়েছে যুদ্ধবিমান ও রাডার সিস্টেম মেরামত, সহায়ক হেলিকপ্টার সংগ্রহ এবং এভিয়েশন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উন্নয়নে।
🔹 কেন এই বাজেট গুরুত্বপূর্ণ?
বর্তমানে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এক জটিল ভূরাজনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতিরক্ষা বাজেট কেবলমাত্র অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নয়, বরং আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায়ও একটি বড় ভূমিকা রাখে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বাজেট এমন সময় এলো যখন:
-
বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় কিছু স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে
-
মিয়ানমার সীমান্তে সংঘর্ষ ও রোহিঙ্গা সঙ্কট নতুন নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করছে
-
বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও শক্তির উৎস ঘিরে প্রতিযোগিতা বাড়ছে
🔹 Forces Goal 2030: স্বপ্ন থেকে বাস্তবায়নে অগ্রগতি
২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার 'Forces Goal 2030' নামে একটি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, যার লক্ষ্য ছিল একটি আধুনিক, দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা। এই বাজেট সেই লক্ষ্য অর্জনের একটি ধাপ।
এই লক্ষ্যের আওতায় ইতোমধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে:
-
চট্টগ্রামে সাবমেরিন ঘাঁটি 'BNS Sheikh Hasina' চালু
-
তৃতীয় ও চতুর্থ সাবমেরিন ক্রয়ের আলোচনা
-
র্যাডার ও মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন
-
সামরিক চিকিৎসা, প্রকৌশল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ
🔹 সামরিক ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা: একটি চ্যালেঞ্জ
যদিও বাজেট বৃদ্ধি একটি কৌশলগত প্রয়োজন, তবে এর স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন উঠে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেটের অনেক অংশই ‘অপ্রকাশিত’ হিসেবে বিবেচিত, যা গবেষক ও নাগরিক সমাজের কাছে উদ্বেগের বিষয়।
বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক ব্যয়ে দায়বদ্ধতা ও জননিরীক্ষা নিশ্চিত না হলে বাজেটের সুফল পুরোপুরি পাওয়া কঠিন। পাশাপাশি, প্রতিটি বড় প্রকল্পের জন্য নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও কার্যকর বাস্তবায়ন মূল্যায়ন থাকা দরকার।
🔹 ভবিষ্যতের পথে: নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন
এই বাজেট প্রযুক্তিনির্ভরতা ও কৌশলগত প্রস্তুতির মাঝে একটি ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টা। ভবিষ্যতের যুদ্ধ হবে অনেকাংশে সাইবার, ড্রোন ও তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক, যেটার জন্য বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের প্রতিরক্ষা নীতিকে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে রেখে স্বনির্ভরতা অর্জনই মূল লক্ষ্য। সেই প্রেক্ষিতে এই বাজেট একটি সাহসী পদক্ষেপ।
উপসংহার
২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রতিরক্ষা বাজেট বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও কৌশলগত নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধু বাহিনীকে শক্তিশালী করার বিষয় নয়; এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুসংহত করার একটি প্রচেষ্টা। তবে স্বচ্ছতা, দক্ষ বাস্তবায়ন এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে এই অগ্রগতি স্থায়ী হবে না।