বাংলাদেশের রাস্তাঘাট এশিয়ায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট
বিশ্বব্যাপী সড়কের মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী অবস্থানে রয়েছে? বিশ্বব্যাপী সড়ক অবকাঠামোর মান নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফল জানাচ্ছে, ১৩৮টি দেশের মধ্যে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত অবস্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। অপরদিকে, তালিকার নিকৃষ্টতম অবস্থানটি দখল করেছে মাদাগাস্কার। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩তম, যা এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশের এই অবস্থান দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে একটি বড় সংকেত হিসাবে ধরা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের সড়ক অবস্থা উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট সকল অংশীদারের একাত্ম উদ্যোগ প্রয়োজন। একই সঙ্গে এটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এই জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, এশিয়ায় বাংলাদেশের নিকৃষ্ট সড়কের অবস্থানের আগে মাত্র একটি দেশ রয়েছে, সেটা হলো নেপাল। নেপালের সড়ক অবস্থা বাংলাদেশের থেকেও অনেক বেশি দুর্বল। এই তথ্যগুলো এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও পরিকল্পনার ঘাটতির একটি প্রতিফলন।
এশিয়ায় সড়ক যোগাযোগের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর, যা বিশ্ব তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এশিয়ার অন্যান্য উন্নত দেশের মধ্যে জাপান ও তাইওয়ানের অবস্থান যথাক্রমে পাঁচ ও ১১তম। দক্ষিণ কোরিয়া এবং মালয়েশিয়া যথাক্রমে ১৪ ও ২০তম স্থানে রয়েছে। বিশ্বে চীনের অবস্থান যথাক্রমে ৩৯তম, যা ক্রমবর্ধমান উন্নতির প্রতীক। চীন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ মহাসড়ক জালের মালিক; যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৫ হাজার কিলোমিটার।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় ব্রুনাই এবং শ্রীলঙ্কার অবস্থান অপেক্ষাকৃত ভালো। ভারতের অবস্থানও উন্নতি লাভ করেছে; এটি ৫১তম স্থানে রয়েছে যা থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো, যাদের অবস্থান যথাক্রমে ৬০ ও ৭৭।
যদিও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভুটানের অবস্থান ৮০তম। ভিয়েতনাম এবং লাওস এখনও সড়ক যোগাযোগে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেনি বলে তাদের অবস্থান তুলনামূলক নিচে। কম্বোডিয়ার অবস্থান ৯৩তম; শহর ও গ্রামাঞ্চলে সড়কের পরিমাণ খুবই কম। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ফিলিপাইনের সড়ক অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ।
বিশ্বব্যাপী সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসাধারণের জীবনমান বৃদ্ধির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। উন্নত সড়ক নেটওয়ার্ক পণ্য পরিবহনকে সহজ ও দ্রুত করে তোলে, যা ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে। আর দুর্বল সড়ক যোগাযোগ নানা ক্ষেত্রে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যে বিলম্ব, দুর্ঘটনা, পরিবেশ দূষণ, এবং জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে সড়ক যোগাযোগের অবস্থা এখনো দুর্বল হওয়ায় এসব সমস্যা প্রকট।
বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে রয়েছে নানা ধরনের বাধা। যেমন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ, এবং পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি। এছাড়া, সড়কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত না থাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে।
সরকার জাতীয় অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সড়ক উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেমন, মহাসড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণ, ব্রিজ নির্মাণ, বাইপাস ও রিং রোড উন্নয়ন, এবং পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে সড়কের অবকাঠামোর গুরুত্ব অপরিসীম। একটি কার্যকর ও নিরাপদ সড়ক নেটওয়ার্ক দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃজাতিক বাণিজ্যের গতিশীলতা বাড়ায়, পর্যটন শিল্পকে প্রসারিত করে, এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে সড়ক উন্নয়নে বিনিয়োগ দেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান উন্নত করে।
বাংলাদেশের জনগণের জীবনে সড়কের অবস্থা সরাসরি প্রভাব ফেলে। দুর্বল সড়ক যোগাযোগ স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এবং অন্যান্য সামাজিক সেবায় পৌঁছাতে বাঁধা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার মানুষের জীবনে এ সমস্যার মাত্রা বেশি। সড়কের উন্নয়ন না হলে গ্রামীণ ও শহুরে জীবনের মধ্যকার দুরত্ব কমানো কঠিন হবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নয়ন অংশীদার বাংলাদেশের সড়ক উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করছে। উন্নত প্রযুক্তি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে উন্নতি করা সম্ভব। পাশাপাশি, সড়ক নিরাপত্তা ও যানবাহন ব্যবস্থাপনার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে।
পরিবেশগত প্রভাবও বিবেচনায় নিতে হবে সড়ক উন্নয়নে। অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
দেশের উন্নয়নের জন্য আধুনিক ও কার্যকর সড়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা সময়ের দাবি। এতে সব স্তরের মানুষের জীবনমান উন্নত হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। সড়ক যোগাযোগের উন্নয়নে সবাইকে সহযোগিতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজন।
বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম সড়ক অবস্থানকে উত্তরণ করতে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা জরুরি। পরিকল্পিত বিনিয়োগ, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার একসঙ্গে হলে বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানো সম্ভব।
বিশ্বব্যাপী চলমান প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের সড়ক নেটওয়ার্ককে উন্নত করতে হবে। উন্নত সড়ক যোগাযোগ দেশের সকল সেক্টরের উন্নয়নে প্রাথমিক অবকাঠামো হিসেবে কাজ করবে।
সমাপ্তিতে বলা যায়, সড়কের মান বৃদ্ধিই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। বাংলাদেশকে এশিয়ার মানচিত্রে উন্নত ও নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ সম্পন্ন একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এখন থেকেই গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে।