পরিবেশ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ত্রিমাত্রিক চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের উন্নয়নচিত্র গত দুই দশকে আমূল বদলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বৈদেশিক রেমিট্যান্স ও শিল্পায়নের প্রসার অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের চেয়েও এগিয়ে রেখেছে। কিন্তু এই উন্নয়ন-ধারার ছায়ায় যে পরিবেশগত ক্ষয় এবং রাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা ক্রমে জমে উঠছে, তা ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর সংকেত। এই ত্রিমাত্রিক সংকট—পরিবেশ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতি—আজ আমাদের উন্নয়নকে একটি কঠিন মোড়ের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।
প্রথমত, পরিবেশগত দিক থেকে দেশ এক ভয়াবহ ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চল লবণাক্ত হয়ে পড়ছে, পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধ্বস বাড়ছে, আর শহরগুলো বায়ু ও শব্দ দূষণের বিষাক্ত ঘেরাটোপে বন্দী। বৃক্ষনিধন, নদী দখল, ভূগর্ভস্থ পানির নিঃশেষন ও উষ্ণায়নের ফলে প্রকৃতি যেন প্রতিশোধ নিচ্ছে। অথচ নীতিনির্ধারক মহল এখনও উন্নয়ন মানেই অবকাঠামো ও জিডিপি বাড়ানো মনে করে, যা পরিবেশের বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির বিপরীতে দেখা যাচ্ছে বৈষম্য, দুর্নীতি ও কর্মসংস্থানের অভাব। ‘গ্রোথ উইদাউট জবস’—এই বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যখন দেখা যায়, বিপুল অবকাঠামো নির্মাণ হলেও শিক্ষিত যুবকদের একটি বড় অংশ বেকার। পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ এলেও সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদি টেকসইতা প্রশ্নবিদ্ধ। নদী শাসন, কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কিংবা শিল্পাঞ্চল—এসব প্রকল্প যতটা না অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়, তার চেয়ে বেশি পরিবেশগত ক্ষয় ডেকে আনে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রনীতি বা গভার্নেন্সের দুর্বলতা এই সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে তুলছে। পরিবেশ সংরক্ষণের আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বৈজ্ঞানিক উপাত্তের ব্যবহার কম, এবং নাগরিক মতামত প্রায় অনুপস্থিত। পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত যে ধরণের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও টেকসই দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, তা প্রাথমিকভাবে অনুপস্থিত। পাশাপাশি, জলবায়ু তহবিল কিংবা আন্তর্জাতিক সহায়তা ব্যবহারে দুর্নীতি ও সুশাসনের ঘাটতি উন্নয়নের গতিকে অনির্ভরযোগ্য করে তুলেছে।
বাংলাদেশ এখন এমন এক সময় অতিক্রম করছে, যেখানে উন্নয়নকে অবশ্যই পরিবেশ এবং রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সমন্বয় করে টেকসই করতে হবে। শুধুমাত্র অবকাঠামো বা অর্থনীতির সূচক দিয়ে ভবিষ্যৎ পরিমাপ করা যাবে না। বরং দেখতে হবে, এই উন্নয়ন কতটা পরিবেশবান্ধব, কতটা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে এবং কতটা ন্যায্যতাভিত্তিক। রাষ্ট্রকে হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, তথ্যনির্ভর ও পরিবেশ সচেতন। অন্যথায় এই অগ্রগতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাবে এক বিষাক্ত পৃথিবী।