পরিবেশ, ভূরাজনীতি ও বৈশ্বিক অর্থনীতি: বাংলাদেশ কোন পথে?
বিশ্ব এখন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি, ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষ, খাদ্য ও জ্বালানি সংকট এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থান একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এই বৈশ্বিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থান একটি সংকটপূর্ণ অথচ কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একদিকে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার, অন্যদিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তির দ্বন্দ্ব, অভিবাসন প্রবাহ এবং উন্নয়ন তহবিল বিতরণের কেন্দ্রবিন্দুতে।
উত্তর গোলার্ধের শিল্পোন্নত দেশগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কার্বন নির্গমন করে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়েছে। অথচ এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো। খরা, অতিবৃষ্টি, নদীভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি দিনে দিনে বাড়ছে, অথচ বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল থেকে এখনো পর্যাপ্ত সহায়তা মেলেনি। ‘লোস অ্যান্ড ড্যামেজ’ ফান্ড বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং উন্নত বিশ্বের প্রতিশ্রুত তহবিল না আসা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর প্রতি একধরনের নৈতিক অমানবিকতা।
অন্যদিকে, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাও বাংলাদেশের পরিবেশ নীতিকে জটিল করে তুলছে। ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—তিনটি শক্তিধর রাষ্ট্রের ভূকৌশলগত আগ্রহে বাংলাদেশ পড়েছে এক কৌশলগত মেরুকরণের চাপে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, ভারতের আঞ্চলিক কর্তৃত্ববাদ ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’—এই ত্রিমাত্রিক চাপ পরিবেশবান্ধব নীতির চেয়ে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য করছে। উদাহরণস্বরূপ, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনের বিনিয়োগ কিংবা এলএনজি আমদানিতে পশ্চিমা তত্ত্বাবধান—উভয়ই জলবায়ু সংকটকে উপেক্ষা করছে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী জ্বালানি সংকট এবং মার্কিন ডলারের আধিপত্য, বাংলাদেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তরের সুযোগ থাকলেও ফিনান্সিং ও প্রযুক্তির অভাবে তা বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। জলবায়ু অভিযোজন ও নবায়নযোগ্য শক্তির খাতে বিদেশি সহায়তা আসলেও তা প্রায়শই শর্তযুক্ত এবং কৌশলগত দখলের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতে করে বাংলাদেশের নীতিকৌশল স্বাধীনতা খর্ব হয়।
তবে বাংলাদেশের জন্য বিকল্প পথও উন্মুক্ত। আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরো কার্যকর জলবায়ু কূটনীতি, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা জোরদার, এবং স্থানীয় প্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক পরিবেশ নীতির বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজস্ব কণ্ঠস্বর জোরালো করা সম্ভব। বাংলাদেশ যদি জলবায়ু অভিবাসন, পরিবেশ-নির্ভর খাদ্যনিরাপত্তা এবং টেকসই নগরায়নে নেতৃত্ব দিতে পারে, তাহলে এটি শুধু একটি “জরুরি সংকটের দেশ” নয়, বরং হয়ে উঠতে পারে একটি “জলবায়ু নেতৃত্বের রাষ্ট্র”।