"জলবায়ু সংকট ও বৈশ্বিক দায়িত্ব: কোথায় দাঁড়িয়ে পৃথিবী?"
বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ সংকট আর শুধু বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় নয়—এটি এখন রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের কেন্দ্রীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া এখন আর কোনো একক অঞ্চলের সীমায় সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে। ২০২৪ সালে বিশ্বের নানা প্রান্তে রেকর্ড মাত্রার দাবদাহ, দাবানল, খরা ও ঘূর্ণিঝড় প্রমাণ করে দিচ্ছে যে পৃথিবী এখন এক জ্বলন্ত জরুরি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
শত শত বছর ধরে শিল্পোন্নত দেশগুলো উন্নয়নের নামে যে হারে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়িয়েছে, তার ফল এখন ভোগ করছে দক্ষিণ গোলার্ধের দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, দক্ষিণ এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ—এগুলো সবচেয়ে কম কার্বন নির্গত করেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মরুকরণ এবং প্রাণীবৈচিত্র্যের বিলুপ্তি—এই সব প্রভাব একসঙ্গে মানুষের জীবন, জীবিকা ও জাতীয় নিরাপত্তাকে অস্থির করে তুলছে।
তবে শুধুই প্রকৃতির রোষ নয়—এই সংকটের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। শিল্পোন্নত বিশ্ব জলবায়ু তহবিলের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরগতিতে, কখনোই প্রয়োজন অনুসারে নয়। জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে (যেমন COP28) যতটা উচ্চারিত হয় ‘ন্যায়সংগত রূপান্তর’ (Just Transition), বাস্তবে দেখা যায় গ্লোবাল সাউথের রাষ্ট্রগুলো ঋণ, প্রযুক্তি বাধা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তাদের অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে।
বিশ্বে এখনও ৭৫ শতাংশের বেশি কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ২০টি রাষ্ট্র। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ যাদের এই সমস্যার সৃষ্টিতে কোনো দায়ই নেই। জলবায়ু অভিবাসন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও পানির সংকট এখন বিশ্বের শান্তি ও মানবিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক দ্বীপ রাষ্ট্র ইতোমধ্যেই তাদের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে দেখছে—যেমন মালদ্বীপ, টুভালু, কিরিবাতি ইত্যাদি।
তবে এ সংকটের মধ্যে দিয়ে সম্ভাবনার দ্বারও খোলা রয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তি, সবুজ প্রযুক্তি, প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এখনই সময় সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, গ্লোবাল গভার্নেন্সে পরিবর্তন, এবং শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর কার্যকর ভূমিকা। শুধুমাত্র বক্তৃতা নয়, এখন দরকার বাস্তবায়িত পরিকল্পনা, জলবায়ু অভিযোজন তহবিলের স্বচ্ছ বণ্টন এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
বাংলাদেশ, ভানুয়াটু, কেনিয়া বা পেরুর মতো দেশগুলোর জন্য এটা অস্তিত্বের লড়াই। তারা চায় না দয়া; তারা চায় ন্যায্যতা। জলবায়ু পরিবর্তনের এই দৌড় আর কেবল গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর প্রতিযোগিতা নয়—এটি এখন সভ্যতা রক্ষার সংগ্রাম। পৃথিবী কি এই সংকেত শুনতে পারবে? সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আশা এখনো হারিয়ে যায়নি।