বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তু: ক্রমবর্ধমান সংকট ও আমাদের ভবিষ্যৎ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ আজ এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছেন। এই সমস্যা দিন দিন এমন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে যে, বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন আগামী কয়েক দশকে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ কাঠামোকে আমূল বদলে দিতে পারে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারেন। এই বাস্তুচ্যুতির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন এবং চরম আবহাওয়া ঘটনাকে।
উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক। নাসার গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা প্রতি বছর ৩ থেকে ৮ মিলিমিটার হারে ডুবে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ বেড়ে যাচ্ছে, যার ফলে কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। অনেক কৃষক তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছেন।
নদীভাঙন বাংলাদেশের আরেকটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ নদীভাঙনের শিকার হন। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের জীবনযাত্রা আজ হুমকির মুখে। নদী তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা গ্রাস করছে, আর তারা ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে আশ্রয় নিচ্ছেন।
চরম আবহাওয়া ঘটনাও জলবায়ু উদ্বাস্তু সৃষ্টির একটি বড় কারণ। ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্পান এবং ২০২২ সালের সিত্রাংয়ের প্রভাবে খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ ও তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে, যা এই সংকটকে আরও গভীর করছে।
এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন জরুরি ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। জলবায়ু-সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ একটি সম্ভাবনাময় সমাধান। সাতক্ষীরায় "টায়ার-ভিত্তিক উঁচু বাড়ি" প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, যা অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলে প্রয়োগ করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতাও অপরিহার্য। Loss and Damage Fund-এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এছাড়াও, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নগর পরিকল্পনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার মতো বড় শহরগুলিতে ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তাই, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য ঢাকার আশেপাশে স্যাটেলাইট টাউন নির্মাণ একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।
জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। এই সংকট মোকাবিলায় আমাদের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।