জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের পরিবেশ: সংকট, সম্ভাবনা ও করণীয়
বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, যদিও এই পরিবর্তনে দেশের অবদান অত্যন্ত নগণ্য। ভৌগোলিক অবস্থান, নিম্নাঞ্চলীয় ভূমি এবং ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশ নিয়মিতভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়, যেমন—ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন ও লবণাক্ততার অগ্রগতি। সম্প্রতি এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ আরও বেড়েছে, যার প্রধান কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অস্থিরতা।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে কৃষিকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে, সুপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বনও এ প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সুন্দরবনের নিম্নভূমি প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থলকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
অন্যদিকে, উত্তরাঞ্চলে খরার প্রকোপ বাড়ছে। কৃষিজ উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি মৌসুমি জলবায়ুর পরিবর্তনে কৃষকেরা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। এমনকি শহরগুলোতেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট—অতিরিক্ত গরম, বায়ু দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং নির্মাণ কার্যক্রমে গাছপালা কেটে ফেলার ফলে শহরের পরিবেশ বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। ঢাকায় গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা আগের চেয়ে ২–৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
তবে সংকটের মধ্যেই সম্ভাবনার দ্বারও উন্মুক্ত রয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ, পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি এবং সবুজ অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পারে। দেশের যুবসমাজ, শিক্ষিত জনশক্তি ও স্থানীয় জ্ঞান এই পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকেও বাংলাদেশ পর্যাপ্ত সহায়তা পেতে পারে, তবে এজন্য দরকার কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা।
ন政策গতভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন কার্যকর করা, গ্রীণ জোন বাড়ানো, প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্পকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নও জরুরি। সর্বোপরি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ শিক্ষা জাতীয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি জরুরি হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু বিজ্ঞান বা প্রকৌশলের বিষয় নয়; এটি এখন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, যা আমাদের জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবিত করছে।
বাংলাদেশ এখনো সময়ের মধ্যে আছে—যদি আমরা সমন্বিতভাবে সরকার, নাগরিক সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে নিয়ে একটি সুদূরপ্রসারী, বাস্তবভিত্তিক পরিবেশনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারি। অন্যথায়, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হয়তো আর এই রূপে বাসযোগ্য থাকবে না।