নগরায়ন ও পরিবেশ: বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের সংকট ও সমাধান
বাংলাদেশের দ্রুত নগরায়ন এখন আর শুধুই উন্নয়নের প্রতীক নয়, বরং এটি পরিবেশ ও অর্থনীতির এক দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে, যার প্রধান কারণ কর্মসংস্থানের খোঁজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু এই অভ্যন্তরীণ জনসংখ্যা চাপ ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোর ওপর এমনভাবে পড়ছে যে, পরিবেশের ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
শহরের বাড়তি জনসংখ্যার কারণে প্রতিনিয়ত গাছপালা নিধন, জলাশয় ভরাট এবং নির্মাণকাজের বিস্তার ঘটছে। ফলস্বরূপ শহর হারাচ্ছে তার প্রাকৃতিক শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থাকে। বায়ু দূষণ, শব্দদূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলাবদ্ধতা এখন নাগরিক জীবনের স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বায়ু মান সূচক (AQI) বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই বিশ্বে অন্যতম নিকৃষ্ট থাকে, যা শিশু ও বয়স্কদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই অস্বাভাবিক নগরায়নের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে উৎপাদনশীল শ্রমশক্তির কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ছে এবং যানজটের কারণে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, শুধু যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হয়, যার বার্ষিক ক্ষতি প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সমান।
শুধু ক্ষতি নয়, পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের সুযোগও রয়েছে। যদি পরিকল্পিতভাবে নগর উন্নয়ন, ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন, সবুজ স্থাপত্য এবং পাবলিক স্পেসের উন্নয়ন করা যায়, তাহলে এ নগরগুলো হতে পারে আগামী দিনের ‘সবুজ অর্থনীতির’ কেন্দ্র। বাংলাদেশে সৌর শক্তি ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ, নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প এবং রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্রযুক্তি প্রয়োগ—এসব ইঙ্গিত দেয় যে পরিবেশ ও অর্থনীতি একসাথে এগোতে পারে, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা থাকে।
সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়, নগর পরিকল্পনাবিদদের কার্যকর সম্পৃক্ততা, এবং জনগণের পরিবেশ সচেতনতা এখন সময়ের দাবি। দেশের ভবিষ্যৎ কেবলমাত্র জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিয়ে মাপা যাবে না; টেকসইতা, বাসযোগ্যতা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধরে রাখা যে কোনো উন্নয়ন সূচকের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। পরিবেশ যদি ধ্বংস হয়, তাহলে অর্থনীতিও হবে ভঙ্গুর; আর সে ভাঙনের শব্দ এখনই শোনা যাচ্ছে।