ভূ-রাজনীতির ফাঁদে বাংলাদেশ

ভূ-রাজনীতির ফাঁদে বাংলাদেশ

Image: The Associated Press

By Alap 24

Reporting from Dhaka - June 26, 2025

ভূ-রাজনীতির ফাঁদে বাংলাদেশ: মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, গণতন্ত্র এবং কৌশলগত স্বার্থ



যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী অনেক দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে—যাদের অনেকেরই দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা স্বচ্ছ নির্বাচন বলতে তেমন কিছুই নেই। তা সত্ত্বেও, বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের এতটা কঠোর অবস্থান গ্রহণ একটি ব্যতিক্রম এবং এই অবস্থানের পেছনে রয়েছে ভিন্নমাত্রিক ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ।

এই কঠোরতার পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক, বিনিয়োগ, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ এবং সর্বোপরি নিরাপত্তা সহযোগিতা—যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দ্বিতীয়ত, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত আধিপত্য ধরে রাখতে চায় এবং বাংলাদেশের অবস্থান সেখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে একটি জনগণের ম্যান্ডেটযুক্ত গণতান্ত্রিক সরকার গড়ে উঠুক, যাতে দেশটি চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব থেকে সরে আসে। এই চাপ প্রয়োগ আসলে বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ, যার লক্ষ্য হলো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ছত্রছায়া থেকে দেশগুলোকে সরিয়ে আনা।

সম্প্রতি বাংলাদেশে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়—দেশটি এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ইন্দো-প্যাসিফিকে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় পড়ে গেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে ভারতের ঐতিহাসিক ও নিত্য সক্রিয় ভূমিকা। ফলে বাংলাদেশ কার্যত তিন দিক থেকে কৌশলগত চাপের মুখে পড়েছে।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করে, তখন এতে উল্লেখ করা হয় যে, বিশ্বের ২৫% ভূমি এবং ৬৫% সামুদ্রিক এলাকা এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা এখানেই বসবাস করে, যার ৫৮% তরুণ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশ, ৬০% জিডিপি এবং ৬০% ভোক্তা এই অঞ্চলেই অবস্থিত। এতে চীন, ভারত, জাপান, কোরিয়া, পাকিস্তানসহ একাধিক প্রভাবশালী দেশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, এই অঞ্চলই এখন বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রূপ নিচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর মধ্যে আটটি দেশের ক্ষেত্রে ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং বাকিদের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেই তালিকায় সবচেয়ে আলোচিত, কারণ এটি নির্বাচন ঘিরে ভিসা নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে ভোটের আগেই—যা অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আরোপিত হয়েছিল।


এই প্রসঙ্গে ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র বিষয়ক তার এজেন্ডাকে সামনে রেখে বাংলাদেশকে একটি ‘দৃষ্টান্তমূলক কেস’ হিসেবে বিবেচনা করছে। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখানে মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করছে—যা বাংলাদেশে বিশেষভাবে দৃশ্যমান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারও স্পষ্টভাবে বলেন, যারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে, তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এই তালিকায় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দল—সবাই থাকবেন। শুধু ব্যক্তি নয়, তার পরিবারের সদস্যরাও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন। ফলে যাদের যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ, ব্যবসা বা বিনিয়োগ আছে, তারাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আরও স্যাংশন দিতে পারে, এটা তাদের ইচ্ছা।” যদিও এটি আত্মবিশ্বাসী বক্তব্য, তবুও নিষেধাজ্ঞার অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত অস্বীকার করার সুযোগ নেই।


মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র মানবাধিকার বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্ন নয়—বরং এর পেছনে রয়েছে কৌশলগত স্বার্থ। যেসব দেশ এই নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে, তাদের অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশে যদি নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসন সম্ভব হতো, তাহলে এমন কূটনৈতিক চাপ এড়ানো যেত।

এখানে উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশ ২০১৬ সালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (BRI) যুক্ত হয়। ২০২১ সালে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ যেন যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন কোয়াড জোটে (Quad) যোগ না দেয়—এটি করলে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

যদিও বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কোয়াডের সদস্য নয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের ওপর কৌশলগত নজর রাখছে। ২০২৩ সালের মার্চে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এক বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের ভূ-অবস্থান এবং সম্ভাবনা এ অঞ্চলে জাপানসহ মিত্রদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের পূর্বে বাংলাদেশ সরকার একটি ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ প্রকাশ করে—যেখানে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতির ভিত্তিতে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের কথা বলা হয়।

এইসব ঘটনাপ্রবাহের পটভূমিতে ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র আবারও জানিয়ে দেয়, বাংলাদেশের অবাধ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যারা বাধা দেবে, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। শুধু ব্যক্তি নয়, তাদের পরিবারও এ বিধিনিষেধের আওতায় পড়বে। যারা যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ কিংবা বিনিয়োগ করেছেন, তা হারানোর ঝুঁকিও থেকে যাবে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশ এখন ভূ-রাজনীতির এক জটিল ফাঁদে আটকে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারতের পরস্পরবিরোধী কৌশলগত প্রতিযোগিতার মধ্যবিন্দুতে অবস্থান করছে ঢাকা। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে—সাবলীল কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐক্য নিশ্চিত করা এবং পরাশক্তিদের চাপ মোকাবেলায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ, স্বার্থ-সচেতন অবস্থান গ্রহণ করা।

Related Topics:

Share: