আসামের ‘মিয়া’ মুসলিমদের নিপীড়ন ও জোরপূর্বক বিতাড়নের ছায়া: একটি মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট

আসামের ‘মিয়া’ মুসলিমদের নিপীড়ন ও জোরপূর্বক বিতাড়নের ছায়া: একটি মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট

Image: The Associated Press

By Admin User

Reporting from Dhaka - June 26, 2025

আসামের ‘মিয়া’ মুসলিমদের নিপীড়ন ও জোরপূর্বক বিতাড়নের ছায়া: একটি মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট


ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে বসবাসকারী বাংলাভাষী মুসলিম সম্প্রদায় আজ এক অদৃশ্য কিন্তু ক্রমবর্ধমান শোষণের শিকার। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হওয়ার, অথচ বহু প্রজন্ম ধরে তারা এই ভূমিতেই বসবাস করছেন, কাজ করছেন, জীবনযাপন করছেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের ঘোষিত ‘বিদেশি নাগরিক ধরপাকড়’ অভিযানের নামে অনেককেই বন্দিশিবিরে আটকে রেখে এবং জোর করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ ঠেলে দেওয়া হচ্ছে — যেখানে খাবার, পানীয়, আশ্রয় কিংবা নিরাপত্তার কোনো বন্দোবস্ত নেই।

২৩ মে ২০২৫ সালে ৬৭ বছর বয়সী আসামের আলী, যিনি জন্মের পর থেকে কখনো বাংলাদেশে পা দেননি, চার দিনের বন্দিশিবির থেকে তুলে এনে জোর করে সীমান্তের ওই দূষিত, জলমগ্ন স্থানেই ফেলে দেওয়া হয়। বিজিবি এবং স্থানীয় বাংলাদেশিরা বাধা দিলেও বিএসএফের নিপীড়ন চলে অবিরাম। আলীর চোখে আতঙ্ক আর যন্ত্রণার ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যা একটি গভীর মানবিক সংকটের পরিচায়ক।

আলীর মতো আরও শত শত মানুষ—যাদের মধ্যে শিক্ষক, ট্রাক চালক, চা বাগানের শ্রমিক ও গৃহিণী—জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যাদের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত মামলা এখনও বিচারাধীন, এবং যারা নথিপত্রের অমিল বা খাটো ভুলের কারণে ‘বিদেশি’ হিসেবে বর্ণিত হচ্ছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা নিজেই স্বীকার করেছেন, এ অভিযান আরও জোরদার হবে এবং ‘আমাদের রাজ্যকে বাঁচাতে’ এ পদক্ষেপ জরুরি।

এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তেজনা। আসামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বাংলাভাষী মুসলিমদের দেখে আসছে, যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের জমা দেওয়া জাতিগত বিভাজনের এক বিস্তার। ২০১৬ সালে বিজেপি আসামে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই বিভাজন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) উভয়পক্ষে বিতর্কিত হয়ে ওঠে; যেখানে হিন্দু, সিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও জৈন সম্প্রদায়কে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে প্রবেশ করলে সহজ নাগরিকত্ব দেয়া হয়, কিন্তু মুসলিমদের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই বৈষম্যমূলক আইন ভারতীয় সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী বলে অভিযোগ উঠেছে।

আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) তালিকা থেকে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাদ পড়েছে, যার অধিকাংশই মুসলিম। এই তালিকা প্রকাশের পর থেকেই ভারত সরকারের জোরপূর্বক বিতাড়ন শুরু হয়, যেখানে বন্দিশিবিরগুলো নির্মিত হয়েছে, যেখানে সারা জীবন বসবাসকারী বহু মানুষকে বন্দি করা হয়। তবে এই বন্দিশিবিরগুলোয় থাকা মানুষদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে কোনো আপীল বা বিচার হয় না।

পুশ ইন বা জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ঠেলাঠেলি, মারধর, রাবার বুলেট ছোড়া ও গুলির হুমকি দিয়ে সীমান্তে ফেলে দেয়া হচ্ছে। যারা সীমান্ত পেরিয়ে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করে, তাদের ওপর গুলি চালানোর ভয় দেখানো হয়। ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হয়ে দাঁড়ানো ওই জলাভূমি ও খোলা মাঠে মানুষের নিরাপত্তা, খাদ্য ও আশ্রয়ের কোনো ব্যবস্থা থাকে না। ফলে তীব্র শীত, গরম, অনাহার আর মানসিক অবসাদে বহু মানুষ মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক কষ্ট ভোগ করছে।

এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের মতো কয়েকটি রাজ্য প্রতিবাদ করলেও মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও আসামে সরকারের নীরব সমর্থন ও পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের মানুষকেও একইভাবে বাংলাদেশি বলে ধরে ঠেলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

সীমান্তবর্তী বাংলাদেশও এই সমস্যার শিকার। তারা অসংখ্য ভারতীয় নাগরিককে উদ্ধার করেছে, কিন্তু একই সঙ্গে অসংখ্য লোক সীমান্তের সাদাপোশাকধারী স্থানীয়দের মাধ্যমে ‘হাইওয়ে’তে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে তাদের জীবন অস্থিতিশীল।

একদিকে ভারতীয় প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ, অন্যদিকে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতার মধ্যে আটকে থাকা এসব মানুষের ভাগ্য মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আসামের মুসলিম সম্প্রদায় ‘মিয়া’ নামে একটি অপমানজনক শব্দের শিকার, যা তাদের জন্য ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং সেই কারণে তাদের অধিকার হরণ করা হয়। বহু মানুষ এক প্রজন্মেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় ভূমিতেই বসবাস করছে, তবু তাদের ওপর অবিচার ও বৈষম্যের হানা অব্যাহত।

এই সংকট শুধু আসামের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি বড় আঘাত। জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের নামে মানুষকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে বিতাড়ন, ধর্মীয় নির্যাতনের অভিযোগ, নাগরিকত্বের প্রশ্ন—এসব মিলিয়ে এক নতুন ধরনের ‘অভিবাসী’ সমস্যা তৈরি হয়েছে, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ।

বিস্তারিত এই সংকট থেকে উদ্ধার ও শান্তির পথের সন্ধান ছাড়া, এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও অধিকার কতদূর নিরাপদ থাকবে তা অজানা।

Related Topics:

Share: