আঞ্চলিক সামরিক জোট (QUAD, BRICS, AUKUS) ও বাংলাদেশের অবস্থান: সম্ভাবনা, চাপ ও কৌশল
বর্তমান বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে যে পরিবর্তন ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তার একটি বড় অংশই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে শক্তিশালী সামরিক ও কৌশলগত জোটগুলোর মাধ্যমে। QUAD (Quadrilateral Security Dialogue), BRICS (Brazil, Russia, India, China, South Africa) ও AUKUS (Australia, United Kingdom, United States)-এর মতো সামরিক ও ভূকৌশলিক জোটগুলো ক্রমাগত আঞ্চলিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। এসব জোটের কার্যক্রম সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরে প্রভাব ফেলছে—যার মাঝখানে বাংলাদেশ অবস্থিত। ফলে এ দেশের জন্য এসব জোট শুধুই আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয় নয়, বরং বাস্তব কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জ।
QUAD মূলত একটি প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাভিত্তিক অংশীদারিত্ব, যার লক্ষ্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানো। ভারত এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হওয়ায় QUAD-এর যে কোনো কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের ওপর পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। তাছাড়া QUAD-এর বিভিন্ন নৌ-মহড়া ও সামুদ্রিক নজরদারি কার্যক্রম বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছিও পরিচালিত হয়। প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ কি এই নতুন সামরিক ভারসাম্যে নিজের অবস্থান নিরপেক্ষ রাখতে পারবে, নাকি চাপের মুখে কোনো এক পক্ষের দিকে ঝুঁকবে?
BRICS একদিকে অর্থনৈতিক জোট হলেও বর্তমানে রাশিয়া ও চীনের সক্রিয় ভূমিকায় এটি একটি বিকল্প জিও-পলিটিকাল ব্লক হিসেবেও পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে BRICS-এ যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে, তবে এতে যুক্ত হতে গেলে পশ্চিমা জোটের (বিশেষ করে AUKUS ও NATO-এর) সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন হবে। BRICS-এর মধ্যে রাশিয়া ও চীন থাকায় এ জোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা মানেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা।
অন্যদিকে, AUKUS মূলত সাবমেরিন ও সামরিক প্রযুক্তি ভাগাভাগির জোট, যার লক্ষ্য চীনের সামুদ্রিক দখলদারিতা রুখে দেওয়া। AUKUS-এর কার্যক্রম সরাসরি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলবে এবং সম্ভবত বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলেও তাদের উপস্থিতি বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলোতে স্থায়ী নজরদারির ব্যবস্থা করেছে, যার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণ বেড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, দ্বিতীয়ত, কৌশলগত বন্ধুত্ব উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা, এবং তৃতীয়ত, প্রতিরক্ষা কূটনীতি শক্তিশালী করা। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে "স্মার্ট বেলেন্সিং" কৌশল নিতে হবে। অর্থাৎ, কোনো এক পক্ষের প্রতি একতরফাভাবে না ঝুঁকে, বরং সব পক্ষের সঙ্গে কৌশলগতভাবে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি দীর্ঘদিন ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতিতে চলে এসেছে। কিন্তু আধুনিক জিও-পলিটিক্সে শুধুমাত্র বন্ধুত্বের কথা বলে নয়, প্রতিপক্ষের অবস্থান ও সম্ভাব্য বিপদের বিষয়েও প্রস্তুতি রাখতে হয়। বাংলাদেশের উচিত এখনই একটি “জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্র” প্রণয়ন করা, যেখানে এসব সামরিক জোটের ভূরাজনৈতিক গতিপথ, সম্ভাব্য প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার দিকগুলো বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রীয় অবস্থান নির্ধারণ করা হবে।
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান—যেখানে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও জাপানের স্বার্থ একযোগে মিশে যায়—তা একদিকে যেমন সুযোগ তৈরি করে, তেমনি ভুল পদক্ষেপ নিলে মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে। তাই এই সময়ে কেবল দ্বিপক্ষীয় নয়, বহুপক্ষীয় কূটনীতি, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণ এবং স্ট্র্যাটেজিক থিংকিং-এর উপর জোর দিতে হবে।