সীমান্তে প্রতিনিয়ত লাশ, অনুপ্রবেশ ও নীরবতা: বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা ও ‘পুশ-ইন’ নামক অবৈধভাবে মানুষ ঠেলে দেওয়া ঘটনা নতুন কিছু নয়। বরং এটি কয়েক দশক ধরেই চলমান এক উদ্বেগজনক বাস্তবতা, যা কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নই তোলে না, বরং বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামোর কিছু মৌলিক দুর্বলতাকেও প্রকাশ করে দেয়। প্রতিবছর সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের অসংখ্য নাগরিক প্রাণ হারান, আবার প্রায়ই ভারতের অভ্যন্তর থেকে অনুপ্রবেশকারী বা নাগরিকদের ধরে সীমান্ত পার করিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। অথচ প্রতিবারই বাংলাদেশ সীমিত প্রতিবাদ জানিয়ে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে না তুলেই ধামাচাপা দেয়। প্রশ্ন হলো—এ ধরনের ঘটনার পেছনে কেবল রাজনৈতিক কূটনীতি দায়ী, নাকি এর পেছনে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কাঠামোর অর্গানিক দুর্বলতাও আছে?
প্রথমত, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতিতে সীমান্ত নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, কিন্তু তার বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। সীমান্ত রক্ষার প্রধান দায়িত্বে থাকা বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এখনো অনেকাংশেই অপ্রতুল। ভারতে যেখানে সীমান্তে নিয়োজিত বিএসএফ আধুনিক অস্ত্র, ড্রোন, নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, সেখানে বাংলাদেশ সীমাবদ্ধ প্রযুক্তি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মধ্যে আটকে রয়েছে। সীমান্তের দীর্ঘ পরিসর (প্রায় ৪,০৯৬ কিলোমিটার) এবং নানা ধরনের ভূপ্রকৃতি সীমান্ত পাহারার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালেও, তদারকির সক্ষমতা ও আগাম সতর্কবার্তার ব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দেখা যায় না।
দ্বিতীয়ত, প্রতিবার যখন সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হন, তখন প্রতিক্রিয়া খুবই সীমিত ও ক্ষণস্থায়ী থাকে। কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ জানানো হয় বটে, কিন্তু তাতে কার্যকর ফল দেখা যায় না। কারণ, এ দেশের পররাষ্ট্রনীতি এখনো প্রতিরক্ষা নীতির সঙ্গে সমন্বয়হীন। প্রতিরক্ষা ও কূটনীতি একত্রে কাজ না করলে, সীমান্ত সমস্যা কখনো সমাধানযোগ্য হবে না। ভারতের সঙ্গে চিরকালীন বন্ধুত্বের মোহে পড়ে বাংলাদেশ এমন একটি নীতি অনুসরণ করছে যেখানে জাতীয় স্বার্থ বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
তৃতীয়ত, ‘পুশ-ইন’ একটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হলেও, বাংলাদেশ এখনো এই বিষয়টিকে জাতিসংঘ, আঞ্চলিক ফোরাম বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার সামনে তোলার কৌশলগত নীতি অনুসরণ করছে না। অথচ প্রতিটি পুশ-ইন শুধু একটি আইনগত লঙ্ঘন নয়, বরং একটি নিরাপত্তা সংকেতও—যে কোনো সময় নিরাপত্তাহীনতা বা সন্ত্রাসীদের ঢুকে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। যদি সীমান্তে গোপন ও অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বাড়ে, তাহলে এর প্রভাব পড়বে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং জনসংখ্যাগত ভারসাম্যের ওপরও।
চতুর্থত, প্রতিরক্ষা কাঠামোর আরেকটি দুর্বলতা হলো স্থানীয় জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা। বহুবার দেখা গেছে, সীমান্তে হত্যা বা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটার পর স্থানীয় প্রশাসন নিরুত্তর থাকে, এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের জন্য কোনো সুরক্ষা বা ক্ষতিপূরণ পরিকল্পনা থাকে না। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ‘মানব নিরাপত্তা’ ধারণার আলোকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে, যেখানে শুধুমাত্র ভূখণ্ড নয়, বরং নাগরিকদের নিরাপত্তাকেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সবশেষে, একটি কার্যকর প্রতিরক্ষা নীতির জন্য প্রয়োজন একটি সর্বজনীন, জাতীয় কৌশল—যেটি সীমান্ত নিরাপত্তা, কূটনৈতিক ব্যাকআপ, প্রযুক্তিগত নজরদারি এবং জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে। সীমান্ত সমস্যাকে কেবল ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক ইস্যু না দেখে এটি একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রশ্ন হিসেবে দেখতে হবে। প্রয়োজনে BIMSTEC বা SAARC-এর মতো ফোরামে এটি তুলে ধরতে হবে।
আমরা যদি এসব বাস্তবতা অনুধাবন করে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তাহলে সীমান্ত কেবল একটি ভূগোলিক রেখা নয়, বরং রাজনৈতিক অপমান ও মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়াবে।