বাংলাদেশে সাইবার যুদ্ধের ঝুঁকি ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি
বর্তমান বিশ্বে প্রতিরক্ষা শুধু সীমান্তে গুলি বা আকাশপথে বিমান হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে এখন যুদ্ধের নতুন ময়দান গড়ে উঠেছে—সাইবার স্পেস। এই ‘অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র’ এতটাই বিপজ্জনক যে, একটিমাত্র সফল সাইবার আক্রমণ গোটা একটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থা, নিরাপত্তা কাঠামো বা জনগণের মনস্তত্ত্বে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশও এখন আর এই ঝুঁকির বাইরে নেই। একটি ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল সমাজে রূপান্তর হওয়ার ফলে, সরকারি নথি, সামরিক তথ্য, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সংযোগ, জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাগুলো এখন অনলাইননির্ভর হয়ে পড়েছে। যার মানে দাঁড়ায়—এই কাঠামোগুলো যদি সাইবার হামলার শিকার হয়, তাহলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা চরম হুমকির মধ্যে পড়বে।
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে একাধিকবার সাইবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক হ্যাকিং কেলেঙ্কারি বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল, যেখানে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছিল। এরপরও দেশের সাইবার নিরাপত্তায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি।
বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইসরায়েল, ইরান—তারা কেবল নিজেদের সামরিক বাহিনী নয়, বরং সাইবার কমান্ড ইউনিট, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিভাগ এবং ডিফেন্স সাইবার অ্যাকাডেমি গড়ে তুলেছে। এদের সাইবার সেনারা ২৪ ঘণ্টা নজরদারিতে থাকে, প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ এবং কৌশলগতভাবে প্রশিক্ষিত।
বাংলাদেশ এখনো এই স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। এখনো প্রতিরক্ষা খাতের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ “সাইবার কমান্ড” গঠিত হয়নি। সেনাবাহিনীর কিছু সীমিত সক্ষমতা থাকলেও, জাতীয় পর্যায়ে সাইবার নিরাপত্তা নীতিমালা অনেকাংশেই খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। সমন্বিত ন্যাশনাল সাইবার স্ট্র্যাটেজি, সাইবার প্রতিরক্ষা আইন, সাইবার সেনা গঠন কিংবা সাইবার হুমকি বিশ্লেষণের মতো বিষয়গুলো এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়।
বর্তমানে যে কোনো আঞ্চলিক উত্তেজনা বা আন্তর্জাতিক সংঘাতের সময় সাইবার হামলা একটি সাধারণ কৌশলে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে দেখা গেছে, কীভাবে উভয়পক্ষ বিদ্যুৎ, পানীয় জল, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং এমনকি গণমাধ্যমে সাইবার হামলার মাধ্যমে প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে কিন্তু সুরক্ষা তেমন গড়ে উঠছে না, সেখানে হ্যাকারদের জন্য প্রবেশদ্বার তৈরি হয়ে যায়। এর ফলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা সামরিক স্থাপনা নয়, বরং ব্যক্তিগত তথ্য, মিডিয়া হাউজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ফোন ও ইমেইলও ঝুঁকির মুখে থাকে।
বাংলাদেশ যদি এখনই কার্যকর সাইবার প্রতিরক্ষা গঠন না করে, তাহলে ভবিষ্যতের কোনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক সংঘাতে ‘প্রথম আঘাত’ আসবে অনলাইনে। সাইবার হামলায় বিদ্যুৎব্যবস্থা বন্ধ, ব্যাংকিং লেনদেন স্থগিত, নির্বাচনী তথ্য বিকৃতি এবং সামরিক কমিউনিকেশন বিভ্রাট ঘটতে পারে।
এর প্রতিকারে, প্রথমেই প্রয়োজন একটি স্বতন্ত্র এবং আধুনিক “ডিফেন্স সাইবার ইউনিট” গঠন, যা সেনাবাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হবে। এ ইউনিটে সাইবার বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তি ইঞ্জিনিয়ার, হ্যাকার (অবশ্যই এথিক্যাল), ও গোপন গোয়েন্দা বিশ্লেষক থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত, দেশে একটি “ন্যাশনাল সাইবার কমান্ড সেন্টার” প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেটা ২৪/৭ সব সরকারি ও কৌশলগত সিস্টেম মনিটর করবে।
তৃতীয়ত, প্রতিরক্ষা বাজেটে সাইবার নিরাপত্তার জন্য আলাদা বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল প্রতিরক্ষা বিষয়ক কারিকুলাম অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা—কারণ সাইবার যুদ্ধে সবচেয়ে দুর্বল লিংক হলো মানুষ নিজে।
সাইবার যুদ্ধ ভবিষ্যতের বাস্তবতা, এবং বাংলাদেশকে এখনই তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। সামরিক শক্তি শুধু অস্ত্র নয়, এখন তথ্যের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও নিহিত।