চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ: বিশ্ব অর্থনীতির একটি বিপর্যয়ের কাহিনি
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই পরাশক্তির মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ নতুন কোনো ঘটনা নয়, তবে ২০১৮ সালের পর থেকে এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে এমন এক দুর্বল অবস্থানে নিয়ে গেছে, যেখান থেকে পুনরুদ্ধার সহজ নয়। এই দ্বন্দ্ব কেবল শুল্ক আরোপ ও পাল্টা-শুল্কে সীমাবদ্ধ থাকেনি; এটি প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, উৎপাদন চেইন, এমনকি ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় শুরু হওয়া এই দ্বন্দ্বের মূল ছিল বাণিজ্য ভারসাম্য ও চীনের প্রযুক্তিগত উত্থান। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল, চীন মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন, ভর্তুকিনির্ভর রপ্তানি ও মার্কিন কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তি জোরপূর্বক স্থানান্তরের মতো কাজ করছে। পাল্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যে প্রায় ৩৭৫ বিলিয়ন ডলারের উপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করে।
চীনও চুপ করে বসে থাকেনি। তারা মার্কিন কৃষি, শিল্প ও প্রযুক্তি পণ্যে পাল্টা শুল্ক বসিয়ে দেয়। এই পাল্টা-পাল্টি নীতির ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন সংকটের সম্মুখীন হয়।
বিশ্ব ব্যাংক ও OECD-এর বিশ্লেষণ বলছে, এই বাণিজ্য দ্বন্দ্ব বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে বছরে ০.৪–০.৬ শতাংশ কমিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি এক নতুন চ্যালেঞ্জ। কারণ, তারা অধিকাংশ সময় সরবরাহ চেইনের মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকে এবং আমদানি-নির্ভর প্রযুক্তি ও কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল।
এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রযুক্তি খাত। হুয়াওয়ে, ZTE, TikTok ও অন্যান্য চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করে মার্কিন প্রশাসন। ‘চিপ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত আধুনিক মাইক্রোচিপ ও সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রযুক্তি নির্ভর ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি তৈরি করেছে।
তাইওয়ান, যেটি বিশ্ব চিপ উৎপাদনের ৬০% এর বেশি জোগান দেয়, এই উত্তেজনার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে। তাইওয়ানকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা কেবল সামরিক ঝুঁকিই বাড়াচ্ছে না, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের শৃঙ্খলাও দুর্বল করছে।
উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপল ও অন্যান্য মার্কিন কোম্পানি চীনের বিকল্প হিসেবে ভারত, ভিয়েতনাম বা মেক্সিকোতে তাদের উৎপাদন সরিয়ে নিচ্ছে, যা বিশ্ব উৎপাদনের কাঠামোয় বড় রদবদল ঘটাচ্ছে। যদিও এতে নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু সাথে যোগ হচ্ছে শ্রমিক অধিকার, উৎপাদন মান ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোও এই দ্বন্দ্বের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত। যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্কবৃদ্ধির ফলে বিশ্বজুড়ে কাঁচামালের দাম বেড়েছে, এবং রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়েছে। ফলে, তৈরি পোশাক ও ইলেকট্রনিক্স খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে এবং কিছু অর্ডার অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে বৈশ্বিক বাণিজ্য ‘ডি-গ্লোবালাইজেশনের’ দিকে যাবে। অর্থাৎ, প্রতিটি দেশ নিজস্ব জোগান নিশ্চিত করতে ‘ফ্রেন্ডশোরিং’ ও ‘নিয়ারশোরিং’-এর দিকে যাবে। এতে করে ছোট দেশগুলোর বিশ্বায়নের সুফল পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
বিশ্ব অর্থনীতি এখন এমন এক পর্বে, যেখানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই “অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ” ও “প্রযুক্তি নিরাপত্তা”র ভিত্তিতে অর্থনীতি পুনর্গঠন করছে। দুই দেশের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্বব্যবস্থাকে বহু মেরুবিশ্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে চীন নেতৃত্ব দিচ্ছে BRICS, আর যুক্তরাষ্ট্র G7 জোটকে শক্তিশালী করছে।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব নেতাদের প্রয়োজন বাস্তববাদী কূটনীতি, বাণিজ্য সংলাপে স্বচ্ছতা এবং WTO-এর মতো সংস্থার কার্যকর পুনর্গঠন। একমাত্র সুশাসন, সংহতি ও পরস্পরের প্রতি আস্থাই পারে বিশ্ব অর্থনীতিকে এই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত করতে।