খেলাপি ঋণ ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি ছাড়াল, প্রকাশ পাচ্ছে আগের সরকারের লুকানো চিত্র:
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এই অঙ্ক ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ফলে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে গোপন রাখা ঋণের প্রকৃত তথ্য এখন প্রকাশিত হওয়ায় এ ঋণের পরিমাণ হঠাৎ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, আগে অনেক ঋণ ‘নিয়মিত’ হিসেবে দেখানো হলেও নতুন সরকারের সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলোকে পুনঃমূল্যায়নের আওতায় এনেছে।
বিশেষ করে কিছু ব্যাংক, যা আগে আলোচিত প্রভাবশালী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল, এখন সেসব ব্যাংকের আর্থিক চিত্র স্বচ্ছভাবে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রুপের প্রভাবমুক্ত ব্যাংকগুলো, যেগুলো বর্তমানে আগের ‘নিয়মিত’ হিসেবে দেখানো ঋণগুলোকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে।
খেলাপি ঋণের তালিকায় আরও উঠে এসেছে বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, ওরিয়ন, সিকদার গ্রুপ এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ঋণের বিষয়টিও। পূর্ববর্তী সরকারের সময় এই ঋণগুলো নিয়মিত হিসেবে দেখা হলেও এখন সেগুলো খেলাপির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক খাতের খেলাপির হার ২০.২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪.১৩ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এক বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটির বেশি। বর্তমানে দেশের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা, যেখানে তিন মাস আগে এই পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি।
ব্যাংক ধরনের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে খেলাপির হার সবচেয়ে বেশি। মার্চ শেষে এসব ব্যাংকের মোট ঋণ ৩ লাখ ১৯ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৭ কোটি খেলাপি। বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপির হার ২০.১৬ শতাংশ, যেখানে মোট বিতরণকৃত ঋণ ১৩ লাখ ১০ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকার মধ্যে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা খেলাপি।
বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ৪.৮৩ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে ১৪.৪৭ শতাংশ, যার পরিমাণ যথাক্রমে ৩ হাজার ২৩৯ কোটি এবং ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ নবায়নে বিলম্ব, পুনঃতফসিল ঋণের কিস্তি পরিশোধ না হওয়া, বড় ঋণের শ্রেণিকরণ এবং সুদের পুনরারোপ—এসব কারণে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী মনে করেন, আগের সরকারের সময়ে ঋণ পুনঃতফসিল, সুদ মওকুফসহ নানা সুবিধা দিয়ে খেলাপির সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। সেই সংস্কৃতি ব্যাংক ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে দিয়েছে। তিনি বলেন, "বর্তমান সরকারের কাছ থেকে জনগণ আশা করেছিল, খেলাপির সংস্কৃতিকে বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে এখনও কার্যকর কোনও দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।"
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই তুলনায় বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২০ গুণ বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন যে, ব্যাংক ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবের ছত্রছায়ায় ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত করা হয়েছে এবং তার বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে।
২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে ব্যাংকগুলোতে আগের সরকারের সময়ে গোপন রাখা ঋণচিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। নতুন সরকার ঋণ পুনঃশ্রেণিকরণের ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করায় খেলাপি হিসাবগুলো আর ‘নিয়মিত’ হিসেবে দেখানোর সুযোগ কমে এসেছে। ফলে এখন বাস্তব চিত্র উঠে আসছে এবং ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট হচ্ছে।