ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিণতি ও এর প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিতে
দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুধু ইউরোপ নয়, গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক ও কৌশলগত মানচিত্র আমূল বদলে দিয়েছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধের সূত্রপাত, তা এখন আর কোনো একক দেশ বা অঞ্চলের সীমাবদ্ধ বাস্তবতা নয়; বরং এটি হয়ে উঠেছে এক নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের প্রতিচ্ছবি, যেখানে পশ্চিমা শক্তি, রাশিয়া, চীন ও অনেক ছোট দেশও একেকটি মোচড় নেওয়া ঘুঁটির মতো ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রথমত, ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিতে একটি ধাক্কা দিয়েছিল, যেটি ইউরোপের নিরাপত্তা চুক্তিগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ন্যাটো, যা এক সময় ছিল কেবল পশ্চিম ইউরোপের প্রতিরক্ষা জোট, আজ তা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মত নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো ন্যাটোতে যোগদান করে, যা এক ঐতিহাসিক ধারা পরিবর্তনের দিকচিহ্ন।
রাশিয়ার ওপর একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত খাতে, বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন ধরনের ছন্দ এনেছে। মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি—এগুলো সরাসরি যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া। ইউক্রেন বিশ্ব খাদ্য সরবরাহের অন্যতম বড় উৎস। রাশিয়াও বিশ্বের অন্যতম তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক। যুদ্ধ সেই শৃঙ্খল ভেঙে দিয়েছে।
চীন এই যুদ্ধকে সরাসরি সমর্থন না করলেও, পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থানকে আড়ালে সমর্থন করে যাচ্ছে। ‘চীন-রাশিয়া সীমাহীন বন্ধুত্ব’ নামের যে সম্পর্ক ২০২২ সালে ঘোষিত হয়েছিল, তা এখন প্রযুক্তি, সামরিক সরঞ্জাম ও জ্বালানিতে দ্বিপাক্ষিক লেনদেনে প্রমাণিত। এ সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লকের জন্য বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক রাষ্ট্র রাশিয়া ও চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে—পশ্চিমা প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-রাজনৈতিক নীতিতে তাই এখন "মিত্র সুরক্ষা" এবং "প্রভাব রক্ষা" গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এদিকে, যুদ্ধটি “প্রক্সি ওয়ার”-এর চরিত্র পেয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে যে পরিমাণ অর্থ, অস্ত্র এবং গোয়েন্দা সহায়তা দিচ্ছে, তা এটিকে কার্যত ন্যাটো বনাম রাশিয়ার যুদ্ধ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে কূটনৈতিক অচলাবস্থা ও সময়ক্ষেপণ শুধু রুশ অর্থনীতি নয়, ইউরোপের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনের ভূখণ্ড নিয়ে নয়, বরং এটি “নতুন বিশ্বব্যবস্থার” রূপরেখা নির্ধারণের একটি সংঘর্ষ। চীন, রাশিয়া, ইরানসহ কিছু দেশ পশ্চিমা মূল্যবোধ ও আধিপত্যভিত্তিক ব্যবস্থার বিকল্প গড়তে চায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একক নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
বাংলাদেশের মতো ছোট ও মাঝারি রাষ্ট্রগুলোও এই বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রভাবে নানাভাবে চাপে রয়েছে। একদিকে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, অন্যদিকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ—এই দুই বলয়ের মাঝে নিজেদের অবস্থান নিরপেক্ষ রাখতে গিয়েও নানা সমস্যায় পড়ছে।
এই যুদ্ধের এক করুণ মানবিক দিক হলো—বিশাল শরণার্থী সঙ্কট, যার ফলে ইউরোপে অভিবাসন নীতিতে রক্ষণশীলতা বেড়েছে এবং ডানপন্থী শক্তি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
শেষ পর্যন্ত, এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে—এই যুদ্ধ কীভাবে বিশ্ব ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করবে। স্নায়ুযুদ্ধ–পরবর্তী বিশ্ব যদি মার্কিন নেতৃত্বে গড়ে ওঠা হয়, তাহলে এই যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব হতে পারে আরও বহুধাবিভক্ত, মেরুকৃত, এবং নতুন পরাশক্তি-ভিত্তিক স্নায়ুযুদ্ধের দিকে ধাবমান।