ইসরায়েলি হামলার ছায়ায় ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার: কুর্দিস্তান অঞ্চল কেন্দ্রবিন্দুতে
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সাম্প্রতিক সংঘাত সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছালেও, এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া থেমে নেই। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরপরই ইরান সরকার দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক নিরাপত্তা তৎপরতা শুরু করে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এবং রাজনৈতিকভাবে অস্থির কুর্দিস্তান অঞ্চলে। সরকারি বাহিনী ব্যাপক চেকপয়েন্ট জোরদার করেছে, অসংখ্য গ্রেপ্তার পরিচালনা করেছে এবং কার্যত একটি ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে—যার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ প্রতিবাদ দমন ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সূত্র অনুযায়ী, ১৩ জুন ইসরায়েলি বিমান হামলা শুরু হওয়ার পরপরই ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী দেশজুড়ে রাস্তাঘাটে অবস্থান জোরদার করে। কুর্দিস্তানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় সন্দেহভাজন ও সমালোচকদের বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার। একাধিক আন্দোলনকারী ও নিরাপত্তা সূত্র জানায়, এই তৎপরতা মূলত সম্ভাব্য বিদ্রোহ দমনে প্রস্তুতির অংশ। আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেছেন, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পরিস্থিতিকে ‘সাম্প্রতিক যুদ্ধের অভিঘাত’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে কঠোর দমনপীড়নের যৌক্তিকতা তৈরির চেষ্টা করছে।
তবে যুদ্ধ ও নিরাপত্তাহীনতার ভেতরে ইরানে গণ-আন্দোলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকে আশা করেছিলেন। ইসরায়েলের অনেক পর্যবেক্ষক এবং প্রবাসী বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো আশা করেছিল—যুদ্ধের চাপে জনগণ রাস্তায় নেমে আসবে, এবং এর মাধ্যমে ইরানের ইসলামিক শাসনের পতনের পথ খুলে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত। জনগণের বৃহৎ অংশ নিশ্চুপ রয়েছে—একদিকে রাষ্ট্রীয় দমন, অন্যদিকে সাম্প্রতিক সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলার ঝুঁকি বিবেচনায় তারা সতর্ক।
২০২২ সালের গণআন্দোলনে অংশ নেওয়া এক অধিকারকর্মী রয়টার্সকে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মনোভাব অনেক বেশি সতর্ক। আমরা জানি, শাসকগোষ্ঠী এই সংকটকে ব্যবহার করতে পারে কোনো নতুন নিষেধাজ্ঞা বা জেল-জরিমানার পথ তৈরির জন্য।” তিনি আরও জানান, নিরাপত্তা বাহিনী আন্দোলনকারীদের ফোন করে হুমকি দিচ্ছে বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নিচ্ছে—যা এক প্রকার মানসিক নিপীড়ন হিসেবেই কাজ করছে।
ইরানভিত্তিক অধিকার সংস্থা HRANA জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৭০৫ জন নাগরিককে রাজনৈতিক অথবা নিরাপত্তাজনিত অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংস্থাটি জানায়, অনেককে "ইসরায়েলের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির" অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যদিও এসব অভিযোগের পেছনে যথাযথ প্রমাণ বা আদালতের প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে—ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উরমিয়া শহরে তিনজন ব্যক্তিকে “মোসাদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি চোরাচালানের” দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংস্থা হেঙ্গাও দাবি করেছে, তিনজনের সবাই কুর্দি এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ছিল না।
কুর্দি গোষ্ঠীগুলো ইতিহাসজুড়ে ইরানে সংবিধানগত অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রের চোখে এই অঞ্চল ‘হুমকির উৎস’ হওয়ায় সেখানে অতিরিক্ত নজরদারি, সেনা মোতায়েন ও রাজনৈতিক নির্যাতন পুরোনো বাস্তবতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ পরিস্থিতির পর ইরানের বর্তমান অভ্যন্তরীণ নীতি বেশ কৌশলগত। একদিকে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা দমন করে একটি "একতাবদ্ধ" রাষ্ট্রীয় চেহারা দেখাতে চায়। তবে এর ফলে রাজনৈতিক মুক্তি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘু অধিকার আরও সংকুচিত হচ্ছে বলেও মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
রয়টার্সের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে ইরানের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য চাওয়া হলেও কোনো তাৎক্ষণিক সাড়া পাওয়া যায়নি।
সবমিলিয়ে, ইরান এখন দুটি যুদ্ধের মধ্যে—একটি বাহ্যিক এবং আরেকটি অভ্যন্তরীণ। বাহ্যিক যুদ্ধ হচ্ছে ইসরায়েলের সঙ্গে, আর অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ হচ্ছে রাষ্ট্রের নিজের জনগণের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়ে। যতক্ষণ না পর্যন্ত সংলাপ, মানবাধিকার রক্ষা ও রাজনৈতিক সংস্কার এগিয়ে আনা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই দুই যুদ্ধের শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকবে—তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।