ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ: লক্ষ্য, প্রেক্ষাপট ও সম্ভাব্য পরিণতি

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ: লক্ষ্য, প্রেক্ষাপট ও সম্ভাব্য পরিণতি

Image: The Associated Press

By Alap 24

Reporting from Dhaka - June 19, 2025

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ: লক্ষ্য, প্রেক্ষাপট ও সম্ভাব্য পরিণতিঃ

যেকোনো সামরিক অভিযানের একটি সুস্পষ্ট কৌশলগত লক্ষ্য থাকা জরুরি। ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি পশ্চিমা দেশের নীরব সমর্থনে ইসরায়েল যে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইরানের ওপর, তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তেহরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত রাখা। যদিও এটি সরাসরি বলা হচ্ছে না, তবে বিশ্লেষকদের মতে এই অভিযানের আরও গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে—ইরানে শাসন পরিবর্তন।

ইসরায়েলের কৌশল হলো, এমন একটি সরকার ইরানে প্রতিষ্ঠিত হোক, যা সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো তেলআবিব-বান্ধব হবে। যে সরকার গাজা বা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের জাতিগত নিধনের নীতি নিয়ে কেবল আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিলেই সন্তুষ্ট থাকবে।

এই যুদ্ধের আরেকটি উদ্দেশ্য—বিশ্বের দৃষ্টি গাজার পরিস্থিতি থেকে অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া। গাজায় মানবিক বিপর্যয় ও জাতিগত নির্মূল অভিযান নিয়ে ইউরোপের কিছু মিত্র দেশ ইতোমধ্যে অস্বস্তি প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় যুদ্ধের নাটক তৈরি করে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক মনোযোগ ঘুরিয়ে নিতে চায়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, গাজার গণহত্যার পেছনে প্রধান কারণ ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলায় ইসরায়েলি জিম্মি হওয়া নয়। তা প্রমাণ হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দূত স্টিভ উইটকফের কার্যক্রমে। তিনি এমন সব সম্ভাব্য চুক্তি থেকে পিছিয়ে গেছেন, যেখানে বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে জিম্মি মুক্তির সুযোগ ছিল। অথচ ইসরায়েলি কারাগারে এখনো শত শত ফিলিস্তিনি বন্দি।

এদিকে, ইসরায়েলের বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো। পাল্টা হামলায় ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলকে বড় ধরনের ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়—এটি কি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামাতে পারবে?

সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান এহুদ বারাক সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এই বিমান হামলা হয়তো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মাত্র কয়েক সপ্তাহ পিছিয়ে দিতে পেরেছে। তার ভাষায়, “ইরানের কাছে এমন পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত আছে, যা দিয়ে গ্যারেজেই বোমা তৈরি করা সম্ভব।”

বারাক আরও বলেন, ইরানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাই মাটির গভীরে পুরনো খনিতে গোপন অবস্থানে রাখা, যা বিমান হামলার নাগালের বাইরে। তাই কূটনৈতিক চুক্তি ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপরই জোর দিতে হবে। বিশেষ করে সৌদি আরবসহ গোটা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য।

বারাক খোলাখুলি বলেছেন—যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ ও সহযোগিতা ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষে বড় পরিসরের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন। তিনি মনে করেন, ইরানে শাসন পরিবর্তন কেবল মার্কিন সেনা মোতায়েন ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু মার্কিন জনগণ ও নেতৃত্বের মধ্যে সেই ইচ্ছা নেই। কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে।

২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে করা ওবামার পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করেন। এই চুক্তি থাকলে ইরানের কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত এবং নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করা সম্ভব হতো। ফলে এখনকার যুদ্ধ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ঠেকানোর চেয়ে, দেশটিকে রাজনৈতিকভাবে নতজানু করতে চাওয়ার ইঙ্গিতই বেশি দেয়।

এই সংঘাতের শেষ কোথায়—তা এখনো অনিশ্চিত। ইসরায়েল শক্তিশালী প্রযুক্তি ও পশ্চিমা অস্ত্রভাণ্ডারের ওপর ভর করে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ইরান বিমান প্রতিরক্ষায় দুর্বল হলেও, তাদের কাছে রয়েছে প্রায় দুই হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। প্রশ্ন হচ্ছে—এই মজুদ কতদিন চলবে?

সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, যদি ইরান আরও কোণঠাসা হয়, তবে তারা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি, সম্পদ বা মিত্রদের ওপর হামলা চালাতে পারে। তখন এটি আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সংকট থাকবে না—এর অভিঘাত ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বজুড়ে, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতির ভারসাম্য কেঁপে উঠবে।

Related Topics:

Share: