পিএলওর যাত্রাপথ: সংগ্রাম, কূটনীতি ও বাস্তবতার আয়নায়

পিএলওর যাত্রাপথ: সংগ্রাম, কূটনীতি ও বাস্তবতার আয়নায়

Image: The Associated Press

By Alap 24

Reporting from Dhaka - June 20, 2025

পিএলওর যাত্রাপথ: সংগ্রাম, কূটনীতি ও বাস্তবতার আয়নায়ঃ

১৯৬৪ সালে মিসরের কায়রোতে আরব লিগের অধিবেশনে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রত্যাশা নিয়ে গঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)। একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে এই সংগঠন শুরুতে ছিল নতুন সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি। একীভূত আরব জাতীয়তাবাদের ছায়ায় গড়ে ওঠা এই সংগঠন সময়ের পরিক্রমায় পরিণত হয় রাজনৈতিক সংগ্রাম, সশস্ত্র প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও বিতর্কের এক জটিল সমন্বয়ে।

দীর্ঘ সময় ধরে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক মানচিত্রে তৈরি হয়েছে রক্তাক্ত ও জটিল অধ্যায়। ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের বিভাজন প্রস্তাব থেকে শুরু করে লাখ লাখ ফিলিস্তিনির দেশছাড়া, যুদ্ধ ও সংঘাত—সব কিছুর কেন্দ্রে রয়েছে একটি মৌলিক আকাঙ্ক্ষা: নিজের ভূমিতে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই জন্ম পায় পিএলও।

অনেকে মনে করেন, পিএলও তাদের মূল লক্ষ্য থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। সময়ের ব্যবধানে সংগঠনটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক আপস ও সমঝোতায় এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে অবস্থান করে। ফলে বাস্তবতায় পিএলও আজ অনেকটাই প্রতীকী ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এক কাঠামোতে পরিণত হয়েছে।


পিএলওর সূচনা: প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতা

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাবে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে পৃথক ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক নগরী হিসেবে পরিচালনার কথা বলা হয়। ইহুদি নেতারা প্রস্তাবটি গ্রহণ করলেও ফিলিস্তিনিরা তাতে সম্মত হননি। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, এতে ইহুদিদের অধিক সুবিধা হবে এবং আরবদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণার পর প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি নিজের ভূমি থেকে উৎখাত হন। শুরু হয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। দীর্ঘ সময় ফিলিস্তিনিদের কোনো সংগঠিত নেতৃত্ব ছিল না। তারা ছিল রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা এক জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন দেশে ছোট ছোট প্রতিরোধ সংগঠন গড়ে উঠলেও সেগুলো কার্যকর কেন্দ্রীয় কাঠামোর অভাবে ছন্দহীন ছিল।

এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৬৪ সালে আরব লিগের সহায়তায় গঠিত হয় পিএলও। এর ছায়াতলে একাধিক ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন একত্রিত হয়। পরে জাতিসংঘে পর্যবেক্ষক মর্যাদা অর্জন করে সংগঠনটি। বর্তমানে পিএলওর নেতৃত্বে রয়েছে ফাতাহ রাজনৈতিক দল।


সাংগঠনিক গঠন

পিএলওর সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা হলো প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল কাউন্সিল (PNC), যাদের দায়িত্ব নীতিনির্ধারণ, নির্বাহী কমিটি নির্বাচন ও সদস্যপদ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। নির্বাহী কমিটি পিএলওর দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিনিধিত্ব করে এবং নীতিনির্ধারক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে।

PNC ও নির্বাহী কমিটির মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে মধ্যবর্তী পরিষদ (Central Council), যার সদস্য সংখ্যা ১২৪ জন। এছাড়া রয়েছে পিএলওর সামরিক শাখা—প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মি (PLA)


আরাফাতের উত্থান ও পিএলওর রূপান্তর

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ পিএলওর মূল নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৬৯ সালে আরাফাত নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে দায়িত্বে ছিলেন।

৭০-এর দশকে পিএলওর কার্যক্রম লেবাননে স্থানান্তরিত হয়। সশস্ত্র প্রতিরোধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠে সংগঠনটি। ১৯৭৪ সালে আরব লিগ পিএলওকে ‘ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। একই বছরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন ইয়াসির আরাফাত—এটাই ছিল প্রথম কোনো অরাষ্ট্রীয় নেতার জাতিসংঘ ভাষণ।


অসলো চুক্তি ও ফলাফল

১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও পিএলওর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক অসলো চুক্তি। এর ফলে গঠিত হয় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (PA), যাকে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার কিছু অংশে সীমিত স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। এই চুক্তি ইয়াসির আরাফাতকে দেশফেরার সুযোগ দেয় এবং অনেকেই এটিকে স্থায়ী শান্তির পথ হিসেবে দেখেছিলেন।

তবে চুক্তির বিরোধিতায় ফুঁসে ওঠে ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থী সংগঠন হামাস। তারা মনে করে, এই চুক্তি জাতীয় স্বার্থের বদলে ব্যক্তিগত ও কূটনৈতিক স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে।


হামাস-পিএলও দ্বন্দ্ব ও বিভাজন

২০০৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে হামাস পিএর নেতৃত্বে আসে। কিন্তু ফাতাহ ও হামাসের ক্ষমতা ভাগাভাগি বিফলে যায়। ২০০৭ সালে গাজা নিয়ন্ত্রণে নেয় হামাস। ফাতাহ পশ্চিম তীর শাসনে ফিরে এলেও দুই অংশের মধ্যে বিভাজন আরও গভীর হয়।

ফাতাহ ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নেয় এবং শান্তি প্রক্রিয়ার পক্ষে। অন্যদিকে, হামাস পুরো ফিলিস্তিন ভূখণ্ড নিজেদের দাবি করে এবং ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

গাজার ওপর হামাসের নিয়ন্ত্রণ এবং দীর্ঘদিনের অবরোধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। কয়েকবার ঐক্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ব্যর্থ হয়।


বর্তমান সংকট ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন

মাহমুদ আব্বাস ২০০৫ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর পিএলও ও পিএর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৭ সালে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকে কোনো নির্বাচন হয়নি, এবং তিনিই একাধারে প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

নতুন নেতৃত্ব গঠনের প্রশ্নে চাপের মুখে গত এপ্রিল মাসে পিএলও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ সৃষ্টি করে এবং হুসেন আল-শেখকে সেই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, এটি নেতৃত্ব সংকট মেটাবে না, বরং অভ্যন্তরীণ বিরোধ আরও বাড়াতে পারে। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্ধারণই হতে পারে সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ।

Related Topics:

Share: