ইউক্রেনের নতুন কৌশলে রাশিয়া কতটা কোণঠাসা?

ইউক্রেনের নতুন কৌশলে রাশিয়া কতটা কোণঠাসা?

Image: The Associated Press

By Alap 24

Reporting from Dhaka - June 21, 2025

ইউক্রেনের নতুন কৌশল: যুদ্ধের মোড় ঘোরাচ্ছে, না কি সময়ক্ষেপণ মাত্র?

রাশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ড্রোন হামলা আলোচনার ঝড় তুলেছে পশ্চিমা বিশ্বে। যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রভাবশালী পত্রিকা এই আক্রমণকে ‘রাশিয়ার পার্ল হারবার’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এমন শিরোনামে আবেগের প্রাবল্য থাকলেও, এই যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র আরও জটিল, বহুমাত্রিক এবং বহুস্তর বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

যুদ্ধের বাস্তবতা হলো, রাশিয়া ধীরে ধীরে ইউক্রেনীয় বাহিনীর ওপর চাপ বাড়িয়ে চলেছে। যদিও ইউক্রেনের এসব আক্রমণ রাশিয়ার অভ্যন্তরে অনিশ্চয়তা এবং কিছু কৌশলগত পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে, তবে তা যুদ্ধের সামগ্রিক ভারসাম্যে নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারেনি।

২০২৪ সালের আগস্টে কুরস্কে ইউক্রেনের অভিযান দিয়ে যেটি শুরু হয়েছিল, তা ছিল তাদের নতুন কৌশলের সূচনা। এ অভিযানে ইউক্রেন ব্যাপক মানবসম্পদ হারায়। একই সময়েই শুরু হয় রুশ ভূখণ্ডে ধারাবাহিক ড্রোন হামলা। ইউক্রেন বুঝেছিল, সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়াকে প্রতিহত করা সহজ নয়, বরং রাশিয়ার অভ্যন্তরে দুর্বল জায়গাগুলোতে আঘাত হানাই হতে পারে বড় কৌশল। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে বিমানঘাঁটি, রেলপথ, রেলসেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সেতু যেমন কের্চ ব্রিজেও হামলা চালানো হয়। এসব হামলা রাশিয়াকে যেমন চাপে ফেলেছে, তেমনি তাদের কৌশলে কিছুটা রক্ষণাত্মক মনোভাব দেখা দিয়েছে।

রাশিয়ার জবাব ছিল ধীর কিন্তু সুদূরপ্রসারী। তারা যুদ্ধের ধরন পাল্টে ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ হয়ে যুদ্ধ শুরু করে, যাতে ইউক্রেনীয় ড্রোন বা কামানের হামলায় বড় ক্ষয়ক্ষতি না হয়। এটি যুদ্ধের গতি কিছুটা মন্থর করে দিলেও কার্যকরভাবে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনে। রাশিয়া এরপর থেকে তাদের লক্ষ্য ঠিক রেখেছে—ইউক্রেনীয় বাহিনীর লজিস্টিক চেইন ধ্বংস করা এবং সম্ভাব্যভাবে তাদের ঘিরে ফেলে দীর্ঘমেয়াদে দুর্বল করে দেওয়া।

অন্যদিকে, ইউক্রেন পশ্চিমা প্রযুক্তি, গোয়েন্দা তথ্য এবং নিজস্ব ড্রোন ও সফটওয়্যার সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে একটি অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশল নিয়েছে। তাদের আক্রমণ কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং রাশিয়ার অভ্যন্তরে গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাসমূলক বিস্ফোরণ, তথ্য সংগ্রহ, সাইবার অপারেশন সবই এর অংশ। গুরুত্বপূর্ণ রাশিয়ান সামরিক অফিসারদের হত্যা, জ্বালানি অবকাঠামোতে আঘাত এবং সেনা সরবরাহের রাস্তায় বিঘ্ন ঘটানো ছিল এই কৌশলের লক্ষ্য। তবে এতসব কার্যক্রম চালাতে গিয়ে ইউক্রেন নিজেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে—যা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত হয়।

রাশিয়া তাদের প্রতিপক্ষের তুলনায় বেশি সামরিক সম্পদ ও মজুদ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং বিশেষভাবে গ্লাইড বোমার ক্ষমতা ইউক্রেনের অস্ত্রভাণ্ডারের তুলনায় অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু গ্লাইড বোমা পেলেও, তা রাশিয়ার ব্যবহৃত বোমার কাছে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। এছাড়া, ইউক্রেনের যুদ্ধবিমানসংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে আসছে। যুদ্ধের বাস্তবতায় রাশিয়ার এই তুলনামূলক ‘ধৈর্যশীল কিন্তু আক্রমণাত্মক’ কৌশল ইউক্রেনের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বেশি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, পশ্চিমা সহায়তার ভবিষ্যৎ। ইউরোপ ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও চীনকে সামলাতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করছে। ফলে ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার উপকরণ সংকুচিত হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সফলতার জন্য কেবল কৌশল নয়, দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চেইন, প্রশিক্ষিত সেনা এবং অস্ত্রের মজুদ প্রয়োজন—যা বর্তমানে ইউক্রেনের জন্য নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠেছে।

ইউক্রেনের সামনে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। তাদের বর্তমান নেতৃত্ব রাশিয়াকে কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে রাজি নয়। তবে তারা যদি স্থিতাবস্থাভিত্তিক একটি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়, তাও রাশিয়া সহজে মেনে নেবে না। যুদ্ধ শেষ করতে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন, যা বর্তমানে দৃষ্টিগোচর নয়। অন্যদিকে, রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বাইরের দুনিয়া তেমন পরিষ্কার কোনো ধারণা রাখে না। এই অস্পষ্টতা আরও জটিলতা তৈরি করছে।

সব মিলিয়ে, ইউক্রেনের নতুন কৌশল যে কৌশলগত নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে তা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেবে এমন ধারণা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। ড্রোন হামলা, গোপন অপারেশন কিংবা সীমান্তে দখলদারি যুদ্ধ—সবই চলমান অবস্থার অংশ। কিন্তু এই যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ এখনও রাশিয়ার হাতেই রয়ে গেছে। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই ইউক্রেনের ওপর চাপ বাড়ছে—সামরিক, কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক—তিন দিক থেকেই।

Related Topics:

Share: